বৃহস্পতিবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৩

শত্রু শত্রু খেলা

রাজনীতি ও কূটনীতি একটি খেলা। আগেও ছিল, এখনও দেশে দেশে ও দলে দলে এ খেলায় মেতে আছেন কুশলী খেলোয়াড়েরা। নিজেদের অপকর্ম-দুষ্কর্ম আড়াল করতে, ব্যর্থতা ঢেকে রাখতে তারা চালিয়ে যান এ খেলা। জনগণ যাতে প্রতিবাদ না করতে পারে সে জন্য চলে তাদের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘোরানোর চেষ্টা। নানারকম আবেগপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, ভাবাবেগের জোয়ার জাগিয়ে তুলে তাদের ক্ষমতা বা অবস্থান বজায় রাখার চলে প্রাণপাত প্রয়াস। তাই দেখি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের এই উপমহাদেশের দু’টি দেশ ভারত ও পাকিস্তান দশকের পর দশক ধরে মেতে আছে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায়। দেশে অভ্যন্তরীণ সঙ্কট তীব্র হয়ে উঠলে তারা ওই খেলাতেই মেতে ওঠেন সমস্বরে। সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ে, নেতাদের গলায় জোর বাড়ে, আর জনগণ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ক্রমাগত হুমকি-ধমকির গর্জনে। বর্তমান দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন এবং অন্যান্য নানা প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ও পরিস্থিতিতে ভারত ও পাকিস্তানের দুই সরকারই হয়ে পড়েছে টালমাটাল। এ অবস্থায় এমন একটি কার্যকর খেলা রক্ষাও করতে পারে তাদের। তবে এমন খেলা খেলতে গিয়ে আগেও কয়েকবার সত্যি-সত্যি যুদ্ধেও জড়িয়ে পড়েছে দু’ দেশ, সীমান্তে বিভিন্ন সময়ে রক্তপাত তো আছেই- এবারও এ খেলার পরিণতি কি হয় তা অবশ্যই দেখার বিষয়।
এসব খেলা দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের দেশের দু’টি বড় দল হয়তো এমন শত্রু শত্রু খেলা খেলেই নিজেদের যাবতীয় ব্যর্থতা-দুর্বলতা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখতে চায় দেশবাসীর। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাসহ আমাদের গভীর আবেগের আরও নানা বিষয়াদিকে কাজে লাগিয়ে তারা বজায় রাখতে চায় ক্ষমতার খেয়োখেয়ি, দুর্নীতির কারসাজি।
তবে রাজনীতি-কূটনীতির এ রকম অব্যাহত খেলা দেশ জাতি সমাজের ওপর অন্তহীন দুর্ভোগই টেনে আনছে বারবার। মানুষের ভাগ্য ফেরাবার উদ্যোগ আয়োজন নেই, কিন্তু নির্যাতন নিপীড়ন চলছেই। বিশ্বসমাজ চিন্তাচেতনা ধ্যান-ধারণায় দিনে দিনে এগিয়ে গেলেও আমরা এখনও খাবি খাচ্ছি প্রতিক্রিয়ার ঘূর্নাবর্তে। এ ব্যাপারে উদাহরণ টানছি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তুলনায় অনেকখানি প্রাগ্রসর ভারত থেকে- এ থেকে বুঝবো আমাদের সমাজ এখন কোথায়, এ সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কারা।
গত ১৬ই ডিসেম্বর রাতে নয়া দিল্লি’র একটি বাসে ২৩ বছর বয়সী এক প্যারামেডিক ছাত্রী শিকার হয় গণধর্ষণের। পত্রপত্রিকায় ভারতের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে এ ঘটনা এবং ধর্ষণ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে।
ধর্ষণের দায়ে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে তিনজনের পক্ষে আদালতে দাঁড়িয়েছেন আইনজীবী মনোহর লাল শর্মা (৫৬)। তিনি বলেছেন, ঘটনার জন্য ধর্ষিতা ও তার পুরুষবন্ধুই পুরোপুরি দায়ী। অত রাতে অবিবাহিত যুগলের ঘুরে বেড়ানোর কারণে এমনটি ঘটেছে। কোন সম্ভ্রান্ত মহিলা ধর্ষণের শিকার হন নি কখনও। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের গায়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডনরাও হাত দেয় না।
ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র নেতা, ছত্তিশগড়ের রায়পুর আসনের সংসদ রমেশ বৈশ (৬৬) বলেছেন, যুবতী বা মহিলাদের ধর্ষণের ব্যাপারটা বুঝতে পারি। তবে শিশু ও বালিকারা যদি ধর্ষণের শিকার হয় তবে তাকে অবশ্যই জঘন্য অপরাধ বলতে হবে। এ ধরনের অপরাধীকে অবশ্যই ফাঁসি দিতে হবে।
আহমেদাবাদের ধর্মীয় নেতা আসারাম বাপু (৭২) বলেছেন, ধর্ষণের ঘটনার জন্য মেয়েটিই দায়ী। ধর্ষকদের ‘ভাই’ সম্বোধন করে প্রাণভিক্ষা চেয়ে নিজেকে বাঁচাতে পারতো সে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ-এর সর্সঙ্ঘচালক (সর্বোচ্চ প্রধান) মোহন ভাগবত (৬৩) বলেছেন, ধর্ষণ ঘটে নাগরিক ‘ইন্ডিয়া’য়- গ্রামীণ ‘ভারত’-এ ঘটে না। পশ্চিমা সংস্কৃতির কুফল এটা।
মহারাষ্ট্র সমাজবাদী পার্টি-র রাজ্যপ্রধান ও সাংসদ আবু আজমি (৫৮) বলেছেন, অনাত্মীয় লোকজনের সঙ্গে মেয়েদের বাইরে যাওয়া উচিত নয়। দিল্লিতে ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছে পশ্চিমা সংস্কৃতির কারণে। গাখোলা পোশাকে মেয়েরা ঘুরে বেড়ালে পুরুষরা আকৃষ্ট হবেই।
মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা’র প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট বাজ ঠাকরে (৪৫) বলেছেন, নয়া দিল্লিতে ধর্ষণের ঘটনার জন্য বিহারিরা দায়ী। বিহারের বাইরে যেখানে যায় এরা সেখানেই আকাজ-কুকাজ করে।
বিজেপি নেতা, ছত্তিশগড়ের স্বরাষ্ট্র, কারাগার ও সমবায় বিভাগের মন্ত্রী নানকি রাম কাঁওয়ার বলেছেন, মেয়েদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে গ্রহদোষে। তাদের গ্রহ এখন প্রতিকূলে।
ছত্তিশগড় রাজ্য নারী কমিশনের প্রধান বিভা রাও বলেছেন, ধর্ষণ ঘটনার জন্য মেয়েরাও সমান দায়ী। তাদের মোটেও যৌন উত্তেজক পোশাক পরা উচিত নয়।
হরিয়ানার হিসার জেলার সামাইন খাপ পঞ্চায়েতের প্রধান সুবে সিং বলেছেন, ধর্ষণের জন্য ফাঁসির বিধান করা হলে এর অপব্যবহার হবে। অনেক মিথ্যা ধর্ষণ মামলা হবে। এর বিচার ৩০২ ধারাতেই সম্ভব।
সিনিয়র সিপিআই-এম নেতা, সাবেক মন্ত্রী আনিসুর রেহমান ধর্ষণ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে পশ্চিমঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আপনি ধর্ষণের শিকার মেয়েদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থ দিতে চেয়েছেন- তা আপনাকে কত দিতে হবে? আপনি ধর্ষিত হলে আপনার জন্য ক্ষতিপূরণ কত ধার্য হবে?
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সাবেক আন্তর্জাতিক প্রধান অশোক সিংহল বলেছেন, পশ্চিমাদের মতো জীবনযাপনের প্রবণতা বিপজ্জক হারে বাড়ছে। এগুলো আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এসবের কারণে ধর্ষণ-নির্যাতন ঘটেছে।
ওদিকে পুদুচেরি সরকার স্কুলের মেয়েদের পোশাক পরিবর্তনের নির্দেশ দিয়েছে। যৌন অপরাধ কমাতে তার স্কুল পোশাকের ওপর ওভারকোট পরতে বলেছে। শিক্ষামন্ত্রী টি তিয়াগর্জন (৫১) বলেছেন, এ রাজ্যের স্কুলছাত্রীদের ওভারকোট পরতে হবে, আলাদা বাসে যাতায়াত করতে হবে আর স্কুলে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা যাবে না।
সিনিয়র বিজেপি নেতা, মধ্যপ্রদেশের শিল্পমন্ত্রী কৈলাশ বিজয়ভার্গিয়া (৫৭) বলেছেন, আসল কথা হলো সীমা। যদি তুমি সীমা লঙ্ঘন করো তবে রামায়নে সীতার যা হয়েছে তোমারও তা-ই হবে। লক্ষ্মণ-রেখা পার হলে রাবণ তোমাকে অপহরণ করবে- সীতাকে যেমন করেছিল।
কংগ্রেস নেতা ও প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির পুত্র অভিজিৎ মুখার্জি (৫৩) বলেছেন, ধর্ষণের প্রতিবাদে মিছিলে যারা আসছে ছাত্রী নামে- তারা আসলে সুন্দরী মহিলা। কড়া মেকআপ গেটআপ নিয়ে তারা আসছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় রূপে সেজে। এ ধরনের মহিলা ডিস্কোতে যায়, সাক্ষাৎকার দেয়- মিছিলে প্রতিবাদে তারা সিরিয়াস নয়।
অন্ধ্র প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি বৎস সত্যনারায়ণ (৫৫) বলেছেন, এত রাতে মেয়েটি কি করছিল বাইরে? মাঝরাতে স্বাধীনতা পেয়েছি বলে কি আমরা মাঝরাতে ঘোরাঘুরি করবো? ওই সময় একটি প্রাইভেট বাসে তার ওঠাই ঠিক হয়নি।
একই প্রসঙ্গে কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষিতা এক মেয়ে সম্পর্কে বলতে গিয়ে পশ্চিমঙ্গ মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ ডা. কাকলি ঘোষ দস্তিদার (৫৪) বলেছেন, এই মেয়েটি আসলে যৌনকর্মী। এটা মোটেও ধর্ষণ নয়। দু’পক্ষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে- মেয়েটি আর তার খদ্দেরের সঙ্গে।
এরপর কোন মন্তব্য নিরর্থক। ভারতে তথা উপমহাদেশে ধর্ষণ সম্পর্কে সমাজনেতা-নেত্রীদের চিন্তাচেতনা কোন পর্যায়ে আছে তা এসব উক্তি থেকেই সহজে অনুমেয়।
sazzadqadir@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন