বৃহস্পতিবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৩

বিশ্বজিৎ দাস: প্রয়াণসম্ভাষণ

সেদিন খুব ভয় পেয়েছিলে তুমি, বিশ্বজিৎ। ৯ই ডিসেম্বর, ২০১২ দিনটি সত্যিই বড় ভয়ের ছিল। ১৮ দলীয় জোট দিয়েছিল সড়ক অবরোধ কর্মসূচি। সরকার দেখিয়েছিল রক্তচক্ষু। মন্ত্রী দিয়েছিলেন হুঙ্কার। ডেকেছিলেন দলীয় ক্যাডারদের মাঠে নেমে ব্যবস্থা নিতে। অস্ত্রশস্ত্রে সেজে তারা মাঠে ছিল সেদিন রক্তপিপাসা নিয়ে। তেমন এক ভয়ানক দিনে পথে বেরিয়েছিলে তুমি, বিশ্বজিৎ দাস। বেরিয়েছিলে জীবিকার টানে। দারিদ্র্যের পীড়নে। সামান্য দরজি দোকানি একটা কাজের দিন অলস কাটাতে পারে না বাড়িতে শুয়ে বসে ঘুমিয়ে। কাজের তাগিদ সেদিন বাড়িছাড়া করেছিল তোমাকে। এর অনেক আগেই বেঁচে থাকার দায়ে হয়েছিলে গ্রামছাড়া, এসেছিলে এই দুঃস্বপ্নের শহরে। দুঃস্বপ্ন বলছি, মাত্র ২৪ বছরের নবীন যুবক, হয়তো স্বপ্নও কিছু ছিল তোমার। ছিল তো নিশ্চয়ই, দারিদ্র্যের পেষণ-পীড়ন মুছে ফেলতে পারে নি সব কিছু, তাই সামনের এই ফেব্রুয়ারিতেই নির্ধারিত ছিল তোমার বিয়ের তারিখ। অপেক্ষা করছিল একজন নববধূ। সাজানো একটা সংসারের সাধ ছিল তারও। কিন্তু সেদিন তুমি চলেছো তোমার কাজের ঠিকানায়... শাঁখারিবাজারের কোন গলিতে। চলেছো নিতান্ত অনিচ্ছায়। হরতাল অবরোধ উত্তেজনা থেকে দূরে থাকা মানুষ তুমি। রাজনীতি তোমাকে টানে না, ক্ষমতার খেয়োখেয়ি  নয় তোমার জন্য। তবুও খদ্দেরের জরুরি প্রয়োজন মেটাতে তোমাকে বেরোতে হয়েছে আপাত নিরাপদ গৃহকোণ থেকে। কিন্তু পথে সেদিন বিরোধীদের কর্মসূচি প্রতিরোধে শুরু হয়েছিল অস্ত্রের মহড়া। ভেবেছিলে আগেভাগে পার হয়ে যেতে পারবে বিপদের ঘেরটুকু। কিন্তু না, তুমি গিয়ে পড়লে ভয় দেখানো ভয়ানকদের মাঝখানে। মিছিল শুরু হলো, বোমা ফাটলো, আর তুমি খুব ভয় পেয়ে গেলে, বিশ্বজিৎ। কি হয়-কি হয় ভয়ে তুমি ছুটলে এদিক-সেদিক, এখানে-ওখানে। তখন তোমার দিকে তাড়া করে আসে ভয়ঙ্করেরা। তোমার পিছু নেয় রক্তপিশাচেরা, ধাওয়া করে তোমাকে। প্রকাশ্যে তারা হামলা চালায় তোমার ওপর। চাপাতি দিয়ে কোপায়, রড দিয়ে পিটায়, ছুরি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে। কিল ঘুষি চড়-থাপড় লাথি মারে অবিশ্রান্ত গতিতে। ছুটে পালাতে চাও, কিন্তু কোথায় আশ্রয়? খুনের নেশায় ক্ষিপ্ত সেই হিংস্র বর্বরেরা পিছু ছাড়ে না তোমার। টেনেহিঁচড়ে ধরে নিয়ে আসে সব আশ্রয় থেকে, ঘিরে ফেলে তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খুনিচক্র। তখন রাষ্ট্র ছিল কোথায়? ছিল  কাছেই। রাষ্ট্রের সেই সময়কার প্রতিনিধি পুলিশ ও অন্যান্য প্রতিনিধি ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। যাতে পরে তারা বলতে পারে ‘আমাদের চোখে কিছু পড়ে নি’, আর চেনা-জানা দুর্বৃত্তদের ‘অজ্ঞাত’ দাবি করে আসামি বানিয়ে কাগুজে মামলা ঠুকতে পারে। ওরা ছাড়াও ছিল সাধারণ মানুষ। জনতা। ছিলেন ২০ টিভি চ্যানেলের ৪০ কর্মী, ২০ পত্রিকা-বার্তা সংস্থার ৪০ সাংবাদিক। সব মিলিয়ে শতাধিক মানুষ। সবার চোখের সামনে ১২-১৩ জন দুর্বৃত্ত পিটিয়ে কুপিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে তোমাকে। কেউ এগিয়ে আসে নি, কথাটি বলে নি। অনেকে ছিল দেখেও না দেখার ভূমিকায়, অনেকে ছিল তথ্য নিয়ে উৎসুক, অনেকে ছিল তোমার নির্মম হত্যার দৃশ্যটি নিখুঁতভাবে ক্যামেরায় ধারণের কাজে ব্যস্ত। নাকি ওরা সবাই সেদিন ছিল ঘাতক পক্ষের সমর্থক? প্রকারান্তরে সহায়ক সহযোগী? নইলে ১০-১২টি চাপাতিধারীর বিরুদ্ধে ১০০র বেশি মানুষ কিছুই করবে না?
    তারপর রক্তাপ্লুত তুমি পড়ে থাকলে রাস্তায়। ছটফট করতে থাকলে জবেহ করা পশুর মতো, কাতরাতে থাকলে মৃত্যু-যন্ত্রণায়। না, সেদিন কেউ এগিয়ে যায় নি তোমার দিকে। কিন্তু গরিব-গুরবো বলে কথা! শেষে তোমার মতো এক গরিবকে তুলে নেয় এক গুরবো রিকশাওয়ালা। ভাড়া মিলবে না জেনেও বয়ে নিয়ে যায় হাসপাতালে। কিন্তু সেখানেও সময়ের চিকিৎসা তোমার জোটে নি, বিশ্বজিৎ। হাতেপায়ে ধরেও চিকিৎসকদের মন গলাতে পারে নি রিকশাওয়ালা। ওই একজন মানুষই কেবল পাশে দাঁড়িয়েছিল তোমার, কিন্তু সে-ও ব্যর্থ হলো শেষে। ঘাতকদের হননেচ্ছাই পূরণ হলো সেদিন। আর হয়েই চললো দিনের পর দিন। সরকারের লোকজন তোমাকে বানাতে চাইলো বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থক, যেন তাহলেই হত্যা করাটা বৈধ হয়ে যায়। বলা হলো, তুমি নিশ্চয়ই বোমাবাজ। আর ঘাতকেরা? পুলিশের গলায়-গলায় চলে তারা, থাকেও। পুলিশ বলে, দেখি নি। চিনি না। মন্ত্রীরা বলে, ও দলে ঢুকে পড়া, ঘাপটি মারা, নাশকতাবাদী!
    বিশ্বজিৎ, আসলে তুমি কেউ নও এ দেশে। জনসংখ্যা শুমারিতে, রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণহানির তালিকায় একটা-একটা সংখ্যা মাত্র। তোমাকে কে মনে রাখে? বড় জোর প্রেস ক্লাবের সামনে একটা দায়সারা মানববন্ধন। তোমার জন্য শহিদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন নয়, সংসদ প্লাজায় শোক-প্রতিবাদ সমাবেশ নয়, সারা দেশে একদিন এক মিনিট নীরবতা পালন নয়। তোমার নামে ৯ই ডিসেম্বর বিশ্বজিৎ দিবস নয়। কিন্ত বিশ্বজিৎ, তুমি আমার আত্মীয়। ছয় দশকের বেশি কালের এই জীবনে পাঁচ দশক ধরে চলেছি কলম পিষে। এ কি এক জীবন! তোমার মতোই দারিদ্র্যের চাপাতি আমাকে কোপায় নিত্য, অসম্মান অপমান উপেক্ষার রড পিটায় ক্রমাগত, ছুরি-চাকু মেরে চলে যাবতীয় বিরুদ্ধতা। আজ তাই তোমার প্রতি আমার এই প্রয়াণসম্ভাষণ। বিশ্বজিৎ, তুমি আমার ভাই। তুমি বাংলাদেশের ভাই।

sazzadqadir@gmail.com

1 টি মন্তব্য:

  1. ওরা সবাই সেদিন ছিল ঘাতক পক্ষের সমর্থক? প্রকারান্তরে সহায়ক সহযোগী? নইলে ১০-১২টি চাপাতিধারীর বিরুদ্ধে ১০০র বেশি মানুষ কিছুই করবে না?
    হ্যাঁ, অবস্থা দেখে তাই মনে হচ্ছে।
    আপনার এ লেখা লেখা নয়, বুকফাটা আর্তনাদ। আপনার সাথে শেয়ার করি আমরা সবাই।

    উত্তরমুছুন