বুধবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

ফুঁসে উঠছে বাংলাদেশ

সাযযাদ কাদির: শাহবাগ চত্বরে আবার সেই ছাত্র-জনতা। সেই উত্তাল তারুণ্য, সেই বাঁধ-ভাঙা উদ্দাম উচ্ছ্বাস, স্লোগানে-স্লোগানে সেই বিক্ষোভ-জ্বালা, সেই প্রত্যয় দৃঢ় শপথ, অঙ্গীকার। যেন এক ঝড়ের উৎস-গর্জন। যে দিকে তাকাই রোদ-ঝলসানো জ্বলজ্বলে মুখ, অতন্দ্র চেতনায় শান্ত কঠিন জাগ্রত জনজোয়ার। দাঁড়াই এ জোয়ারের মাঝখানে, রচনা করি দু’টি পঙ্‌ক্তি - ‘মনে ক্ষোভ পুষে পুষে/ বাংলাদেশ উঠছে ফুঁসে।’ মনে পড়ে কবিকিশোর সুকান্তকে। তার অমর পঙ্‌ক্তিগুলো উচ্চারণ করি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে- ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া হঠাৎ বাংলাদেশ... জ্বলে পুড়ে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ মাথা নত না করার এ উত্থান আমাদের বহুপ্রত্যাশিত, প্রজন্মের এ অভ্যুদয় আশান্বিত করে - বুক ভরে দেয় বিশ্বাসে - আমরা থাকবো না, কিন্তু ওদের হাতে দেশ থাকবে নিরাপদ, পরিবর্তনের গতিধারায় এগিয়ে চলবে জাতি। তখন বাধা দিলে বাধবে লড়াই, সে লড়াই চলবে আপসহীন। দ্রোহী চেতনায়, রক্তের বন্ধনে চিনি এ ছাত্র-জনতাকে। এই জনসমুদ্রের একজন আমি, সে ও আরও অনেকে। বায়ান্ন’র সংগ্রাম-আন্দোলনের চেতনায় আমাদেরও এমন যাত্রা শুরু হয়েছিল বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনে। ছাত্র-জনতা আমরা এমন বিক্ষোভে তখন উত্তাল করে তুলেছি শহর-জনপদ। তারপর ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে, আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে- এই আমরাই ছিলাম। গত পঞ্চাশ বছরে আন্দোলন সংগ্রামে কত ত্যাগ ও তিতিক্ষা, কত রক্ত ও অশ্রু এই ছাত্র-জনতার। মনে পড়ে ১৪৪ ধারা ভেঙে বাষট্টির মিছিলের এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য, ঊনসত্তরে কারফিউ অগ্রাহ্য করে রাজপথে আকাশ-কাঁপানো স্লোগান দিয়ে নেমে পড়া মানুষের ঢল। পথে-পথ কত কাঁটাতারের ব্যারিকেড তখন, অত্যাচারের স্টিম রোলার, বাতাসে বারুদের গন্ধ। একাত্তরে রণাঙ্গণে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা এই ছাত্র-জনতাই। সে সময় মুক্তির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান। প্রতিবারই গর্বিত গৌরবের বিজয় ছিনিয়ে এনেছি আমরা, কিন্তু তারপর? পথে পথে সে বিজয়ের উল্লাস-আনন্দ ছড়িয়ে পড়তে না পড়তে শুরু হয়েছে প্রাসাদ-ভবনে নানা শলা-পরামর্শ, ব্যস্ততা, তোড়জোর। বৈঠক, বক্তৃতা, বিবৃতি, আলোচনা। তারপর উড়ে এসে জুড়ে বসা রাজনীতি ছিনিয়ে নিয়েছে বিজয়কে। বিভ্রান্ত হয়েছে ছাত্র-জনতা। রাজনীতির ছদ্মাবরণে ঢুকে পড়েছে নষ্ট নেতা, ভ্রষ্ট বুদ্ধিজীবী, সং সংস্কৃতিজন। আন্দোলন-সংগ্রামের সুফল ধীরে-ধীরে চলে গেছে ফের প্রতিক্রিয়ার শক্তির কাছে। কেবল বদল হয়েছে চেহারার, রঙের, লেবাসের। কিন্তু সেই বঞ্চনা, দুর্নীতি, শোষণ, দুঃশাসন চলতেই থাকে। শক্তের অপরাধ চলে প্রতিকারহীন। এভাবে গত পঞ্চাশ বছরে বারবার প্রতারিত হয়েছে সংগ্রাম-আন্দোলনে উজ্জীবিত ছাত্র-জনতা, বারবার বিজয়ের পতাকা খামচে ধরেছে প্রতিক্রিয়ার কালো হাত। কিন্তু আর কত? শাহবাগ চত্বর এবার রুখে দাঁড়িয়েছে অপরাজনীতির বিরুদ্ধে। বেনো জলের মতো ঢুকে পড়া ছল- কৌশলকে ঠেকাতে চাইছে প্রবল প্রতিরোধে। বক্তৃতার ভাঙা রেকর্ড বাজাতে মানা করেছে তারা। বলেছে, না- কোন রাজনীতি নয়। হুঁশিয়ার করেছে নেতাদের। কাউকে বানিয়ে দিয়েছে খামোশ। কাউকে দিয়েছে তাড়িয়ে। এবার উচ্চারণ একটিই- ফাঁসি চাই ঘাতক দালালের। আপস নয়, আঁতাত নয়। আর বিজয় ছিনতাই নয়।
sazzadqadir@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন