আমার মাতৃভাষা বাংলা। এ ভাষায় কথা বলি, লিখি। এ ভাষায় লেখা বইপত্র পড়ি। এ
ভাষার সূত্রে ঘনিষ্ঠ হয়েছি আরও অন্তত চারটি ভাষার সঙ্গে। ঐতিহ্যিক সূত্রে
ওই ভাষা চারটি গ্রথিত হয়েছে আমাদের ভাষায়, আমাদের জীবনে ও কর্মে। ঐতিহ্যের
মধ্যে রয়েছে ধর্মীয়, প্রশাসনিক ও ঔপনিবেশিক। এসব সূত্রে আমরা পেয়েছি
সংস্কৃত, আরবি, ফারসি ও ইংরেজি ভাষাকে। সংস্কৃত ভাষা কেবল ধর্মাচরণে নয়, এ
ভাষার সাহিত্য আমাদের সাহিত্যকেও পরিপুষ্ট করেছে। বাংলা ভাষার বেশির ভাগ
শব্দ তৎসম অর্থাৎ সংস্কৃত থেকে সরাসরি এসে স্থান করে নিয়েছে নয় উদভূত
হয়েছে। আমাদের ব্যাকরণও বহুক্ষেত্রে সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুসারী। অন্যদিকে
আরবি বিশেষভাবে ইসলাম ধর্মের ঐতিহ্যে স্থান করে নিয়েছে এ দেশের বেশির ভাগ
মানুষের জীবনাচরণে। সেই সঙ্গে লেখা ও পড়ায়। ফারসি-ও কিছুটা যুক্ত ধর্মীয়
ঐতিহ্য ও সাহিত্যচর্চার সূত্রে। তবে তুর্কি মুগল পাঠান যুগে এ ভাষাই ছিল
রাজভাষা। প্রায় ৭০০ বছর এ ভাষায় চলেছে যাবতীয় রাজকার্য, শাসন-প্রশাসন।
ইংরেজ আমলেরও প্রথম প্রায় ১০০ বছর চলেছে এ ভাষার অব্যাহত ব্যবহার। তারপর
এসেছে ইংরেজি। এ ভাষা আবার আমাদের প্রথম অগ্রাধিকারের আন্তর্জাতিক ভাষা।
সেদিকে লেখা পড়া চর্চায় ইংরেজি হয়ে উঠেছে এ দেশের বাংলাভাষীদের দ্বিতীয়
মাতৃভাষা। এখানেই শেষ নয়। আমরা যুক্ত আছি প্রতিবেশী ভাষাগুলোর সঙ্গে।
সেগুলোর মধ্যে অসমিয়া, ওড়িশা’র চেয়ে উরদু হয়ে উঠেছে বেশি ঘনিষ্ঠ। এর কারণ
বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে উরদুভাষীদের ব্যাপক হারে এ বাংলায় আগমন। তারপর
পাকিস্তানি যুগের ২৫ বছরে উরদুর ব্যাপক প্রচলন। এছাড়া লাহোর ও মুম্বইয়ের
ছবির ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তার ফলে উরদু’র পাশাপাশি হিন্দিও হয়ে ওঠে আমাদের
ঘনিষ্ঠ। এখন টেলিভিশনের ব্যাপক প্রসারের কারণে হিন্দি পরিচিত হয়ে উঠেছে ঘরে
ঘরে। কাজেই এই এতগুলো ভাষার সঙ্গে সেই ছোটবেলা থেকেই বড় হয়ে উঠি আমরা।
আমাদের কাজে কেবল নয়, এর জোরালো প্রভাব পড়ে আমাদের কথাবার্তাতেও। আমার
নিজের কথা বলি। আরবি-ফারসি সম্পর্কে মোটামুটি জানাশোনা থাকলেও, এ দু’টি
ভাষার বর্ণমালা চিনলেও, প্রাথমিক ব্যাকরণ জানলেও, আমি সেভাবে পড়তে পারি না,
লিখতেও পারি না। আর ইংরেজি আমার জন্য মাতৃভাষা বাংলার মতোই হয়ে উঠেছে। এ
ভাষায় যদিও লেখালেখি করি না, কিন্তু করি অন্য সকল কাজ। পড়া, শোনা, দেখা,
বলা, অনুবাদ, সাংবাদিকতা, সামাজিক যোগাযোগ ও অন্য অনেক কিছু। এখানেই শেষ
নয়। উপমহাদেশের প্রাদেশিক ভাষাগুলো এবং উল্লিখিত ভাষাগুলো ছাড়াও প্রবাসী
বাংলাদেশীদের অনেকেই বহু ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। সুইডিশ, ফরাসি, জার্মান,
স্প্যানীশ, ইতালিয়ান, জাপানি, কোরিয়ান, মেকহিকান, মালয়, নেপালি প্রভৃতি
ভাষা জানেন ও বলেন এমন অনেক বন্ধু ও আত্মীয় আমার এই ঢাকা শহরেই আছেন। আমি
নিজে চীনা ভাষার সঙ্গে পরিচিত। লিখতে পড়তে না পারলেও এক সময় বলায় দক্ষতা
ছিল ১৯৭৮-৮০ সালে চীন দেশে বসবাসের সুবাদে। এ জন্য এখনও ইংরেজি উচ্চারণে
‘বেজিং’ ‘বিজিং’ ‘বেইজিং’ না লিখে আমি বিশুদ্ধ চীনা উচ্চারণেই লিখি
‘পেইচিং’। কথা আছে আরও। আমাদের এই বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও আছে অন্যান্য
জাতি। তাদের আছে নিজস্ব ভাষা। কোন-কোন ভাষার লিপি আছে। কোন-কোন ভাষার লিপি
উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে। মাতৃভাষার প্রতি আমাদের যেমন মমতা, মাতৃভাষাকে নিয়ে
আমাদের যেমন অহঙ্কার- ঠিক তেমন মমতা ও অহঙ্কার তাদেরও আছে। উপসংহারে বলি,
বাংলাদেশের বাঙালি হলেও একমাত্র বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের জীবন নয়। প্রায় এক
ডজন অন্য ভাষা নানা সূত্রে ঘনিষ্ঠ হয়ে আছে আমাদের। এ ঘনিষ্ঠতা প্রায়
অবিভাজ্য। কাজেই সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন সম্ভব নয়। সম্ভব সর্বাধিক
স্তরে প্রচলন। তাই আমাদের স্লোগান হওয়া উচিত- সর্বাধিক স্তরে বাংলা চাই।
তাহলে আমাদের শিক্ষা, সেই সঙ্গে অগ্রগতি হবে সুনিশ্চিত। এ কথাগুলো বলে আসছি
১৯৭২ সাল থেকে। আজ আবারও বললাম।
sazzadqadir@gmail.com
sazzadqadir@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন