বৃহস্পতিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

তীর ছুড়তে গেলে

যে যাই বলুন কিন্তু কে কি চান - তা আমরা জানি ভালভাবেই। আওয়ামী লীগ চায় ক্ষমতায় থেকে যেতে। বিএনপি চায় হারানো ক্ষমতা ফিরে পেতে। বামপন্থিরা চায় বিপ্লব ঘটাতে। ধর্মান্ধরা চায় সাম্প্রদায়িক স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু আমরা কি চাই? আমরা এই গণমানুষ। গরিবগুর্বো জনসাধারণ।
    ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কি-কি করবে তা অনুমান করা কঠিন নয় কারও পক্ষে। আওয়ামী লীগ চাইবে ৫ আসনের জামায়াতকে ০ আসনে আর ৩০ আসনের বিএনপিকে ৫ আসনে নামিয়ে দিতে। আর বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ যা-যা করেছে তার সবই করবে চরম মাত্রায়। ধর্মান্ধদের আশা পূরণ হবে না কখনওই, কারণ এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ ধর্মপ্রাণ - তাঁরা ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দেন নি কোনও দিন, দেবেনও না। আর বামপন্থিরা অনেক দুস্তর পথ পাড়ি দিয়ে এ পর্যন্ত এসেছেন, আমার মনে হয় - আরও দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে তাঁদের। মহামতি লেনিন বলেছেন, A revolution is impossible without a revolutionary situation; furthermore, not every revolutionary situation leads to revolution. অর্থাৎ বৈপ্লবিক পরিস্থিতি ছাড়া বিপ্লব সম্ভব নয়, আবার প্রতিটি বৈপ্লবিক পরিস্থিতি-ও পৌঁছয় না বিপ্লবে। কাজেই বাংলাদেশে কখন সে সঠিক পরিস্থিতি দেখা দেবে তা-ও বলা সম্ভব নয়। ষাটের দশকের শুরুতে বামপন্থিরা বলতেন, নিরঙ্কুশ সাম্যবাদের কথা। সত্তরের দশকে বললেন, সমাজতন্ত্র চাই। আশির দশকে চাইলেন গণতন্ত্র। নব্বই দশক থেকে বলছেন নির্বাচনের কথা। এর মধ্যে অনেক বামপন্থি নিজেকে বিলীন বা বিলুপ্ত করেছেন ডানপন্থায়। এ অবস্থায় মনে হতে পারে, তাঁরা পিছু হটেছেন ক্রমশ। কিন্তু তা ঠিক নয় বলে মনে করি আমি। তীর ছুড়তে গেলে তাকে টেনে পিছন দিকে নিতে হয়। তাহলেই লক্ষ্যের দিকে যেতে পারে তা। বামপন্থিরা বিপ্লবের লক্ষ্যে পৌঁছতে নিজেদের উদ্যত করে নিয়েছেন মাত্র, যথাসময়েই লক্ষ্যভেদী তীর ছুড়বেন তাঁরা। এছাড়া, সুভাষচন্দ্র বসু’র কথায় বলি, “বিপ্লবের পথ একেবারে ঋজু পথ নয়। এ পথে নিরবচ্ছিন্নভাবে সাফল্য আসে না, এ পথ বহু বিঘ্নসঙ্কুল, সুদীর্ঘ এবং সর্পিল।” তবুও বিপ্লব ছাড়া গত্যন্তর কি আমাদের? স্বাধীনতার পর গত বিয়াল্লিশ বছরে এত জঞ্জাল জমেছে যে বৈপ্লবিক শক্তি ছাড়া আর কোনও শক্তির পক্ষে সাফ করা সম্ভব নয় তা। সেই কবে ‘পথের দাবী’ উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “বিপ্লব শান্তি নয়। হিংসার মধ্যে দিয়েই তাকে চিরদিন পা ফেলে আসতে হয় - এই তার বর, এই তার অভিশাপ।... মহামানবের মুক্তি সাগরে মানবের রক্তধারা তরঙ্গ তুলে ছুটে যাবে সেই তো আমার স্বপ্ন। এত কালের পর্বতপ্রমাণ পাপ তবে ধুয়ে যাবে কিসে?” আমাদের তাই বিপ্লব চাই তিমিরবিনাশী। আজ শাহবাগ চত্বরে দেখছি সেই বিনাশী বিপ্লবের পূর্বাভাস। ফাগুনের আগুনে রাঙা এক সূচনা। নূতনের কেতন উড়েছে, জয়ধ্বনি উঠেছে দিকে-দিকে। তাই লিখেছি ‘শাহবাগের মোড় / বিপ্লবের ভোর। / শাহবাগ চত্বর / বাংলার অন্তর।’ এখন থেকে আর কোনও কিছুই সহজ হবে না প্রতিষ্ঠার প্রতিভূদের পক্ষে। এবার দিচ্ছি ফেসবুক-বন্ধু শুভ কিবরিয়া’র দেয়াল থেকে গোলাম মোর্তোজা’র লেখার উদ্ধৃতি: “শুধুমাত্র  ক্ষমতায় যাওয়ার এই রাজনীতি অতি নিম্ন শ্রেণীর রাজনীতি। নিম্ন রুচির রাজনীতি। শাহবাগের আন্দোলন এই রাজনীতির বিপক্ষে। সুস্থ, মঙ্গল চিন্তার প্রত্যশিত রাজনীতির পক্ষে। নবজাগরণের দাবি রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ, যুদ্ধাপরাধীমুক্ত বাংলাদেশ। সরকার কিছুটা রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে, ভোটের রাজনীতির অংশ হিসেবে এই আন্দোলনের পক্ষে। বেশ কিছুটা পক্ষে বাধ্য হয়ে। জনমতকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা সরকারের নেই। এতদিন সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার করছিল, আবার টালবাহানাও করছিল। নবজাগরণের চাপে টালবাহানা বাদ দিয়েছে কিনা তা এখনও দৃশ্যমান নয়। সরকারকে তা দৃশ্যমান করতে হবে। যদি ট্রাইবুনালের সংখ্যা বাড়ানো হয়, অযোগ্যদের বাদ দিয়ে অথবা রেখে যদি যোগ্য তদন্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়ানো হয়, যদি বাড়ানো হয় দক্ষ, আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত আইনজীবীদের সংখ্যা - তবে দৃশ্যমান হবে বিচার নিয়ে সরকারের আন্তরিকতা। পাশাপাশি সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে একটি কার্যকর গবেষণা সেল করাটা অতীব জরুরি।”
১৪.০২.২০১৩
sazzadqadir@rediffmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন