প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬)-এর বিপুল সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। রক্ষা পেয়েছিল শুধু ওড়িশা এবং পূর্ববঙ্গের সাজাদপুর, পতিসর ও শিলাইদহের জমিদারি। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) শেষ উইল করেন ১৮৯৯ সালের ৮ই সেপটেম্বর। সে অনুযায়ী ওড়িশার জমিদারি পান তাঁর তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৪-১৮৮৪); দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ পান শিলাইদহ (প্রাচীন নাম খোরশেদপুর), সাজাদপুর ও পতিসরের জমিদারি। উইলে জমিদারির আয় থেকে ব্যয় বরাদ্দ করা হয় এভাবে - ছোটভাই নগেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৯-১৮৫৮)-এর স্ত্রী ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীকে মাসে ১০০০ টাকা, পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ১২৫০ টাকা, সোমেন্দ্রনাথকে ২০০ টাকা, রবীন্দ্রনাথকে ২০০ টাকা, বীরেন্দ্রনাথকে ১০০ টাকা, তাঁর স্ত্রী প্রফুল্লময়ীকে ১০০ টাকা, তাঁর পুত্রবধূ সাহানা দেবীকে ১০০ টাকা, কন্যা সৌদামিনী দেবীকে ২৫ টাকা, তাঁর জামাতা সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়কে ৫০ টাকা, কন্যা শরৎকুমারী দেবীকে ২০০ টাকা, স্বর্ণকুমারী দেবীকে ১০০ টাকা, বর্ণকুমারী দেবীকে ১০০ টাকা, আদি ব্রাহ্মসমাজকে ২০০ টাকা, শান্তিনিকেতন ট্রাস্টকে ৩০০ টাকা, দেবসেবার জন্য ২০০ টাকা, পৌত্র দ্বিপেন্দ্রনাথকে ৫০০ টাকা। মাসে এই বিপুল অর্থ যোগানোর জন্য দায়বদ্ধ ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ। ১৯১২ সালে দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর হিস্যার এক-তৃতীয়াংশ বছরে ৪৪,০০০ টাকার বিনিময়ে ইজারা পাট্টা দেন সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের কাছে। সিভিল সারভিসের চাকরিসূত্রে সত্যেন্দ্রনাথ থাকতেন বাংলার বাইরে। কাজেই বছরে ৯৭, ৪০০ টাকার জন্য দায়ী রইলেন রবীন্দ্রনাথই। এছাড়া জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ব্যয় ও জমিদারি পরিচালনার জন্য বছরে কমপক্ষে খরচ হতো কমপক্ষে দুই লাখ টাকা। আর তিন জমিদারির সদর খাজনা দিতে হতো ৫০,০০০ টাকা। শিলাইদহের সদর খাজনা ছিল ১৬,৯০২ টাকা।
জমিদারি কাজকর্মের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের ওপর পূর্ণ আস্থা ছিল দেবেন্দ্রনাথের। তবুও ১৮৯০ সাল থেকে পুরো পাঁচটি বছর জমিদারি তদারকের দায়িত্ব দিয়ে তাঁকে তিনি সরজমিন প্রশিক্ষণ দেন এ বিষয়ে। ১৮৯৬ সালের ৮ই অগস্ট পাওয়ার অভ অ্যাটর্নির মাধ্যমে সমগ্র সম্পত্তির সর্বময় কর্তৃত্ব রবীন্দ্রনাথের ওপর ছেড়ে দেন দেবেন্দ্রনাথ। ১৮৯০ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৭ বছর শিলাইদহ, সাজাদপুর ও পতিসরের জমিদার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বহন করেছেন পিতার দেয়া গুরুভার। তাঁর প্রজাদের বেশির ভাগই কৃষক। কৃষিতে উন্নতি ছাড়া তাদের জীবনে উন্নতি ঘটবে না, তাঁর জমিদারি বা দেশেরও উন্নতি হবে না। তাই জমিদারিতে চালু করেছিলেন ম-লিপ্রথা, সালিশী, হিতৈষীসভা প্রভৃতি ব্যবস্থা। নোবেল প্রাইজের এক লাখ ২০ হাজার টাকা জমা রেখেছিলেন পতিসরের এগ্রিকালচারাল ব্যাংকে। তাঁর কৃষক প্রজারা স্বল্প সুদে ঋণ পেতেন ওই ব্যাংক থেকে। এতে মুসলমান কৃষকরা উপকৃত হলেও হিন্দু সুদ-ব্যবসায়ী ‘সাহা’রা ক্ষেপে যায় রবীন্দ্রনাথের ওপর। তারা নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে জমিদারির বিরুদ্ধে।
তবে দমেন নি রবীন্দ্রনাথ। প্রজারা যাতে অল্প জমিতে অধিক ফসল উৎপাদন করতে পারে এজন্য কৃষি ল্যাবরেটরি স্থাপন করেছিলেন তিনি। বাস্তবায়িত করেছিলেন সমবায় নীতি। প্রজাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন নিখরচায়। জমিদারিতে পুণ্যাহ সভায় আসন বণ্টনে তুলে দিয়েছিলেন জাতিভেদ প্রথা।
প্রজাদের কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন রবীন্দ্রনাথ। মাঝেমধ্যে একাই বেরিয়ে পড়তেন প্রজাদের কথা শুনতে। প্রজাদের কাছ থেকে শুনেছেন আমলাদের অত্যাচারের কথা, বিশ্বাসও করেছেন সে সব কথা। সতর্ক করার পর একই ভুল করলে বরখাস্ত করেছেন তাদের।
১৮৯৫ সালে কুষ্টিয়ায় টেগোর অ্যান্ড কোং চালু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। চাষিদের ধান, পাট ও ভুষিমাল কিনে বাজারে বিক্রি করতো এ কোমপানি। তাঁরা আখ মাড়াইয়ের কলও বসিয়েছিলেন কুষ্টিয়ায়। ম্যানেজার টাকা চুরি করে পালিয়ে যাওয়ায় ব্যবসা ছাড়তে বাধ্য হন রবীন্দ্রনাথ। পরে নামমাত্র খাজনায় ওই ব্যবসা দান করেন এক কর্মচারিকে। জমিদারির সেরেস্তার কাজে গোড়া থেকেই আধুনিক ব্যবস্থা চালু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জমা ওয়াশিল কাগজের পরিবর্তে ছিল কার্ড ইনডেঙ প্রথা।
রবীন্দ্রনাথের বেশির ভাগ ছিল প্রজা ছিল মুসলমান। জমিদারিতে তারা পেতো শুধু বরকন্দাজের কাজ। হিন্দুরা করতো আমলার কাজ। এ নিয়ে সৃষ্ট ক্ষোভ দূর করতে আমিন, মহুরি, তহশিলদার প্রভৃতি পদে শিক্ষিত মুসলমান প্রজাদের নিয়োগ করেন রবীন্দ্রনাথ। এতে হিন্দু আমলা ও প্রজারা প্রাত্যহিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটাতে থাকে নানাভাবে। তখন বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে শিক্ষিত হিন্দু যুবকদের নিয়ে এসে বিভিন্ন পদে নিয়োগ করেন তিনি।
প্রজাদের বিদ্যাচর্চার জন্য শিক্ষালয় স্থাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ, শরীরচর্চার জন্যও চালু করেছিলেন লাঠিখেলা সহ বিভিন্ন খেলাধুলা। গ্রামীণ শিল্প ও বিনোদনচর্চাকে উৎসাহ দিতে প্রতি বছর আয়োজন করতেন পক্ষকালব্যাপী কাত্যায়নী মেলা।
রবীন্দ্রনাথের জন্য ভাতা বরাদ্দ ছিল ২০০ টাকা, জমিদারি কাজের জন্য আর পেতেন ১০০ টাকা। এই মাত্র ৩০০ টাকায় পাঁচ পুত্র-কন্যা সহ সাত জনের সংসার চালাতেন জমিদার-পত্নী মৃণালিনী দেবী। এছাড়া ছেলেমেয়েদের গৃহশিক্ষক, অতিথি আপ্যায়ন, স্বামী ও সন্তানদের বই কেনা প্রভৃতির খরচ তো ছিলই। কলকাতা থেকে আত্মীয়-স্বজনও এসে থাকতেন প্রায়ই। এস্টেটের দারোয়ান, গ্রামের কাজের মহিলা, দূরের কর্মচারিদেরও ছিল মেসবাড়ি।
আজ যাঁরা শিলাইদহ, সাজাদপুর ও পতিসরের ‘জমিদার’ তাঁরা কিভাবে কি করছেন জানতে বড় ইচ্ছা করে। দেশের সরকার ও প্রশাসক ‘জমিদার’রাই কেমন থাকেন, কেমন চলেন ও বলেন তা-ও তুলনা করে দেখতে ইচ্ছা করে। আজ যাঁরা ভক্তির চেয়ে আড়ম্বরে বেশি উৎসাহী তাঁরা যে পূজার ছলে তাঁকে ভুলেই থাকে - তা তিনি সেই তখনই জানতেন।
sazzadqadir@rediffmail.com
জমিদারি কাজকর্মের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের ওপর পূর্ণ আস্থা ছিল দেবেন্দ্রনাথের। তবুও ১৮৯০ সাল থেকে পুরো পাঁচটি বছর জমিদারি তদারকের দায়িত্ব দিয়ে তাঁকে তিনি সরজমিন প্রশিক্ষণ দেন এ বিষয়ে। ১৮৯৬ সালের ৮ই অগস্ট পাওয়ার অভ অ্যাটর্নির মাধ্যমে সমগ্র সম্পত্তির সর্বময় কর্তৃত্ব রবীন্দ্রনাথের ওপর ছেড়ে দেন দেবেন্দ্রনাথ। ১৮৯০ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৭ বছর শিলাইদহ, সাজাদপুর ও পতিসরের জমিদার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বহন করেছেন পিতার দেয়া গুরুভার। তাঁর প্রজাদের বেশির ভাগই কৃষক। কৃষিতে উন্নতি ছাড়া তাদের জীবনে উন্নতি ঘটবে না, তাঁর জমিদারি বা দেশেরও উন্নতি হবে না। তাই জমিদারিতে চালু করেছিলেন ম-লিপ্রথা, সালিশী, হিতৈষীসভা প্রভৃতি ব্যবস্থা। নোবেল প্রাইজের এক লাখ ২০ হাজার টাকা জমা রেখেছিলেন পতিসরের এগ্রিকালচারাল ব্যাংকে। তাঁর কৃষক প্রজারা স্বল্প সুদে ঋণ পেতেন ওই ব্যাংক থেকে। এতে মুসলমান কৃষকরা উপকৃত হলেও হিন্দু সুদ-ব্যবসায়ী ‘সাহা’রা ক্ষেপে যায় রবীন্দ্রনাথের ওপর। তারা নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে জমিদারির বিরুদ্ধে।
তবে দমেন নি রবীন্দ্রনাথ। প্রজারা যাতে অল্প জমিতে অধিক ফসল উৎপাদন করতে পারে এজন্য কৃষি ল্যাবরেটরি স্থাপন করেছিলেন তিনি। বাস্তবায়িত করেছিলেন সমবায় নীতি। প্রজাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন নিখরচায়। জমিদারিতে পুণ্যাহ সভায় আসন বণ্টনে তুলে দিয়েছিলেন জাতিভেদ প্রথা।
প্রজাদের কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন রবীন্দ্রনাথ। মাঝেমধ্যে একাই বেরিয়ে পড়তেন প্রজাদের কথা শুনতে। প্রজাদের কাছ থেকে শুনেছেন আমলাদের অত্যাচারের কথা, বিশ্বাসও করেছেন সে সব কথা। সতর্ক করার পর একই ভুল করলে বরখাস্ত করেছেন তাদের।
১৮৯৫ সালে কুষ্টিয়ায় টেগোর অ্যান্ড কোং চালু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। চাষিদের ধান, পাট ও ভুষিমাল কিনে বাজারে বিক্রি করতো এ কোমপানি। তাঁরা আখ মাড়াইয়ের কলও বসিয়েছিলেন কুষ্টিয়ায়। ম্যানেজার টাকা চুরি করে পালিয়ে যাওয়ায় ব্যবসা ছাড়তে বাধ্য হন রবীন্দ্রনাথ। পরে নামমাত্র খাজনায় ওই ব্যবসা দান করেন এক কর্মচারিকে। জমিদারির সেরেস্তার কাজে গোড়া থেকেই আধুনিক ব্যবস্থা চালু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জমা ওয়াশিল কাগজের পরিবর্তে ছিল কার্ড ইনডেঙ প্রথা।
রবীন্দ্রনাথের বেশির ভাগ ছিল প্রজা ছিল মুসলমান। জমিদারিতে তারা পেতো শুধু বরকন্দাজের কাজ। হিন্দুরা করতো আমলার কাজ। এ নিয়ে সৃষ্ট ক্ষোভ দূর করতে আমিন, মহুরি, তহশিলদার প্রভৃতি পদে শিক্ষিত মুসলমান প্রজাদের নিয়োগ করেন রবীন্দ্রনাথ। এতে হিন্দু আমলা ও প্রজারা প্রাত্যহিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটাতে থাকে নানাভাবে। তখন বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে শিক্ষিত হিন্দু যুবকদের নিয়ে এসে বিভিন্ন পদে নিয়োগ করেন তিনি।
প্রজাদের বিদ্যাচর্চার জন্য শিক্ষালয় স্থাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ, শরীরচর্চার জন্যও চালু করেছিলেন লাঠিখেলা সহ বিভিন্ন খেলাধুলা। গ্রামীণ শিল্প ও বিনোদনচর্চাকে উৎসাহ দিতে প্রতি বছর আয়োজন করতেন পক্ষকালব্যাপী কাত্যায়নী মেলা।
রবীন্দ্রনাথের জন্য ভাতা বরাদ্দ ছিল ২০০ টাকা, জমিদারি কাজের জন্য আর পেতেন ১০০ টাকা। এই মাত্র ৩০০ টাকায় পাঁচ পুত্র-কন্যা সহ সাত জনের সংসার চালাতেন জমিদার-পত্নী মৃণালিনী দেবী। এছাড়া ছেলেমেয়েদের গৃহশিক্ষক, অতিথি আপ্যায়ন, স্বামী ও সন্তানদের বই কেনা প্রভৃতির খরচ তো ছিলই। কলকাতা থেকে আত্মীয়-স্বজনও এসে থাকতেন প্রায়ই। এস্টেটের দারোয়ান, গ্রামের কাজের মহিলা, দূরের কর্মচারিদেরও ছিল মেসবাড়ি।
আজ যাঁরা শিলাইদহ, সাজাদপুর ও পতিসরের ‘জমিদার’ তাঁরা কিভাবে কি করছেন জানতে বড় ইচ্ছা করে। দেশের সরকার ও প্রশাসক ‘জমিদার’রাই কেমন থাকেন, কেমন চলেন ও বলেন তা-ও তুলনা করে দেখতে ইচ্ছা করে। আজ যাঁরা ভক্তির চেয়ে আড়ম্বরে বেশি উৎসাহী তাঁরা যে পূজার ছলে তাঁকে ভুলেই থাকে - তা তিনি সেই তখনই জানতেন।
sazzadqadir@rediffmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন