মঙ্গলবার, ২৯ মে, ২০১২

ঊর্মিমালা ও জগন্নাথ

পশ্চিমবঙ্গের নন্দিত বন্দিত বাচিক শিল্পী ঊর্মিমালা বসু-কে ধন্যবাদ জানাবো না, তবে সারা জীবন মনে রাখবো তাঁকে। আমার এই জীবন দুঃখ-দারিদ্র্যে লাঞ্ছিত বঞ্চিত বিড়ম্বিত হলেও অনেক অভাবনীয় অকল্পনীয় শুভাশিসে ধন্য হয়েছে বহুবার। সে সব আশিস্‌ যেভাবে গ্রহণ করেছি মনপ্রাণ ভরে, স্মরণে বরণীয় করে রেখেছি অসীম কৃতজ্ঞতায় - ঠিক তেমন করেই ঊর্মিমালা’র দান থাকবে আমার পরম পাওয়ার সঞ্চয়ে। তিনি কি করে আমাকে চিনলেন, আমার কবিতাকে ভালবাসলেন - সে এক বিস্ময়! তারপর সারদা-তারা মিউজিক-এর ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে’ অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করলেন আমার ‘এখন’ কবিতাটি - সে আরও এক বিস্ময়। অনুষ্ঠানটির বেশির ভাগ অংশ দেখার সুযোগ হলেও ওই আবৃত্তির অংশটুকু দেখতে পারি নি - ঠিক তখনই ঝুপ করে লোডশেডিং নেমে আসায়। এ কারণে লোডশেডিং এবং এর সংশ্লিষ্ট সব কিছুকে শক্ত অভিশাপ দিয়েছি চীনা ভাষায় - বাংলা ভাষায় মনের মতো যুতসই কথা খুঁজে না পাওয়ায়।
    ঊর্মিমালা ও তাঁর স্বামী জগন্নাথ বসু - দুই কীর্তিধন্য বাচিক শিল্পী বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে অত্যন্ত সুপরিচিত দুই ব্যক্তিত্ব। ‘সোনায় সোহাগা’, ‘মানিকজোড়’, ‘রাজযোটক’ প্রভৃতি শব্দবন্ধে এই যুগলের বর্ণনা সঠিক হবে না বলে এখানেই থামছি, আশা করছি তাঁদের জন্য নতুন কোনও রূপশব্দ খুঁজে পাবো - নয় নিজেই কোনও দিন পারবো তৈরি করে নিতে। আচ্ছা, ‘জগমালা বসু’ বললে কেমন হয়?
    ঊর্মিমালা তুলনামূলক সাহিত্যে এম এ করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পেশাদার শ্রুতি নাটকের জগতে তারকা হয়ে ওঠার অনেক আগে, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. রমা চৌধুরী (১৯১১-১৯৯১)-র তত্ত্বাবধানে সংস্কৃত নাটকে তিনি অভিনয় করতেন বেতারে ও মঞ্চে। ওই সময়টায় বিয়ে হয়, ১৯৭১ সালের ১০ই অগস্টে। নিউ আলিপুরের বিদ্যাভারতী স্কুলে শিক্ষকতা করছিলেন, তখন ঊর্মিমালার বিশেষ ঝোঁক পড়ে শ্রুতিনাটকের দিকে। ১৯৭২ সাল থেকে শুরু করেন অল ইনডিয়া রেডিও’র ‘বিবিধ ভারতী’ সার্ভিসের নাটকে অভিনয়। পরে কলকাতা কেন্দ্রে নাটকে অডিশন দিয়ে উত্তীর্ণ হন। নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি দীর্ঘকাল উপস্থাপক ছিলেন আকাশবাণী কেন্দ্রের ‘এফএম, কলকাতা’র। ১৯৮৩ সালে, স্বামীর সঙ্গে মিলে ঊর্মিমালা গড়ে তুলেছেন উন্মেষ বাচনিক শিক্ষা কেন্দ্র। এর মাধ্যমেই তাঁরা প্রথম আয়োজন করেন সাড়াজাগানো ‘শ্রুতিনাট্যোৎসব’ (১৯৮৪)। ২০০৭ সাল থেকে উন্মেষ-এর শাখা ‘কথানদী’র একক চালিকা ঊর্মিমালা।
মঞ্চে তাঁর প্রথম অভিনয় করেন ১৯৭৬ সালে, স্বামী পরিচালিত ‘আত্মজা’ নাটকে। সেই থেকে জড়িয়ে আছেন মঞ্চাভিনয়েও। সুন্দরম্‌ প্রযোজিত ‘অলকানন্দার পুত্রকন্যা’য় তিনি ছিলেন নামভূমিকায়। এ নাটকের প্রদর্শনী হয়েছে দু’ শ’রও বেশি। ১৯৯০ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নাট্য একাডেমি এ নাটককে দিয়েছে ‘শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা’র পুরস্কার, মুখ্য চরিত্রের অভিনেত্রীকে দিয়েছে ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী’র সম্মাননা। ওই বছর ভারতের সেরা সাংস্কৃতিক সাফল্য হিসেবে এশিয়া পেইন্টস লি.-এর ‘শিরোমণি পুরস্কার’ও পেয়েছে নাটকটি। উল্লেখ্য, সুন্দরম্‌ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৭ সালে, প্রখ্যাত নাট্যজন মনোজ মিত্র, পার্থপ্রতিম চৌধুরী প্রমুখের উদ্যোগে। এ গোষ্ঠীর ‘মুন্নি ও সাত চৌকিদার’ নাটকেও অভিনয় করেছেন ঊর্মিমালা। খ্যাতিমান নাট্যজন রমাপ্রসাদ বণিক (১৯৫৪-২০১০)-এর ‘থিয়েটার প্যাশন’-এর প্রযোজনায় অভিনয় করেছেন ‘ত্রাতা’ নাটকে। এছাড়া অভিনয় করেছেন অসিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘আকরিক’ (‘চুপকথা’ প্রযোজিত), অলোক দেব পরিচালিত ‘কেনারাম বেচারাম’ (‘প্রতিকৃতি’ প্রযোজিত), দেবেশ চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘চলমান অশরীরী’ (‘কল্পায়ু’ প্রযোজিত) প্রভৃতি নাটকে। টেলিফিল্ম, মেগা সিরিয়াল প্রভৃতিতে পরিচিত মুখ ঊর্মিমালা। ‘তৃষ্ণা’, ‘সোনার হরিণ’ প্রভৃতি মেগাসিরিয়ালে তাঁর অভিনয় নিশ্চয়ই মনে আছে অনেকের। বড় পরদাতেও ঊর্মিমালা’র উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। শতরূপা সান্যাল পরিচালিত ‘অনু’, অঞ্জন দাস পরিচালিত ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ (২০০৭) প্রভৃতি তাঁর অভিনীত ছবি। কিছু দিন আগে অভিনয় করেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষের হিন্দি ছবি ‘সানগ্লাস’-এ। ছবিটি এখন মুক্তিপ্রতীক্ষায়।
    পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বসু-দম্পতি ঢাকা এসেছিলেন গত ১৩ই এপরিল (৩০শে চৈত্র), ২০১২। এর আগে জানুয়ারিতে এসেছিলেন রণেশ দাশগুপ্তের স্মৃতি-অনুষ্ঠানে, তখন আমি ছিলাম হাসপাতালে। এবার আসার পর যোগাযোগ হতেই জানা গেল ওঁরা আছেন আমার বাসার কাছেই এক হোটেলে। সেখানে দেখা ও কথা হয় কয়েক মিনিট। অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত হয়ে রুমে বসেছিলেন ওঁরা, গাড়ি নিয়ে গাইডের আসার অপেক্ষায়। ঊর্মিমালাকে দেখে বিশ্বাস হতে চায় নি প্রথমে, ছবিতে যেমন দেখা যায় তার চেয়ে অনেক স্মিতমধুর তিনি, ছোটবেলায় দেখা পাড়ার ভট্টাচার্য-বাড়ির প্রতিমার মতো। দু’ চোখের বিবাদ ঘোচাতে তাই ছুঁয়ে দেখতে চাই হাত বাড়িয়ে। হেসে হাত এগিয়ে দেন ঊর্মিমালা। এরপর পরিচিত হই জগন্নাথ বসু’র সঙ্গে। আলোচনা শুরু হয় কলকাতায় আমাদের অভিন্ন পরিচিতদের নিয়ে। প্রথমে কবি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়ের কথা। তাঁর কবিতাও ঊর্মিমালা আবৃত্তি করেছিলেন সেদিন ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে’ অনুষ্ঠানে। এক সময় প্রতিবেশী ছিলেন ওঁরা। আর কাকতালীয় ভাবে, কবি তারাপদ রায়ের প্রয়াণের পর যে উদার স্নেহাশিস্‌ থেকে আমি বঞ্চিত হয়ে আছি, তা এখন কানায়-কানায় পূর্ণ করে দিয়েছেন কবি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথা নিয়েই তারাপদ রায়ের কথা ও কাহিনী একে-একে স্মৃতি থেকে উদ্ধার করি তিনজনে। এর মধ্যে ঊর্মিমালা ব্যাগ খুলে বের করেন কলকাতা থেকে আমার জন্য নিয়ে আসা উপহার - রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প অবলম্বনে দু’টি শ্রুতিনাটক ‘রবিবার’ ও ‘ভুল স্বর্গ’; হিমানীশ গোস্বামী, বিমল কর, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বনানী মুখোপাধ্যায়, বিধায়ক ভট্টাচার্য্য, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ও মনোজ মিত্রের রচনা অবলম্বনে ১০টি ‘সরস শ্রুতিনাটক’ এবং জগন্নাথ বসু’র স্মৃতিকথা ‘বেতারের কথকতা এবং’ (আনন্দ, ২০১০)। অসামান্য সব উপহার, কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা ভুলে যাই। বলি, আপনারা বাচিক শিল্পী... কিন্তু আমি তো অর্বাচিক।
    জগন্নাথ বসু বলেন, তারাপদ রায়ের সঙ্গে যে আপনার কতখানি কি মেলামেশা ছিল তা বুঝলাম। উনি এমন করেই কথা বলতেন।
    অনুষ্ঠানের গাইড, গাড়ি ও তাড়া এসে যায় এর মধ্যে। হোটেলের আট তলা থেকে নিচে নামতেই কবি হাসান হাফিজ যোগ দেন আমাদের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত এক কর্মসূচি ছিল আমার। পরিচয় করিয়ে দিতেই জগন্নাথ বসু বলেন, আপনার নাম জানি। চিনি আপনাকে।
    একটু অবাক হন হাসান হাফিজ। তারপর কথা এগিয়ে চলে ওঁদের।
    আসলে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে হাসান হাফিজ শুধু সুপরিচিত নন, ‘দেশ’ পত্রিকার ঢাকা প্রতিনিধি হিসেবে - সেই তখন থেকে - গোটা বাংলাভাষী জগতে বিশেষ সুপ্রিয়ও তিনি। আমাদের দু’চার কথায় পরিচয় মেলে সেই প্রিয়তার।
    রাতে টেঙট মেসেজে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা, কুশল ও বিদায় ঊর্মিমালা’র সঙ্গে। এর পর সময় কাটে জগন্নাথ বসু’র অন্তরঙ্গ স্মৃতিকথায় ডুবে। প্রখ্যাত অভিনেতা প্রেমাংশু বসু’র ভাইপো তিনি, আকাশবাণী-দূরদর্শন কলকাতা কেন্দ্রের প্রযোজক ছিলেন, প্রশাসনিক কর্মকর্তাও ছিলেন। এখন অতিথি অধ্যাপক যাদবপুর ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের। তাঁর স্মৃতিকথা ষাট-সত্তর দশকের আকাশবাণীর বেতার-নাটক ও কলকাতার মঞ্চ-নাটকের নানা বৃত্তান্ত, নাট্যশিল্পীদের  অনেক কৌতূহলোদ্দীপক কথা ও কাহিনী, সেই সঙ্গে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার বর্ণনা এবং দুর্লভ কিছু আলোকচিত্রে সমৃদ্ধ। ওই সময় আকাশবাণী’র নাটকের মুগ্ধ শ্রোতা ছিলাম আমি। ‘বেতারের কথকতা এবং’ পড়তে-পড়তে তাই ফিরে যাই সেই সময়ে, জানতে পারি আমার ভাল লাগা অনেক নাটকের প্রযোজক ছিলেন তিনি।  আরও জানতে পারি সে সব নাটক প্রযোজনার নেপথ্য কাহিনীও কম নাটকীয় ছিল না মূল নাটকের চেয়ে। আমার ক’জন প্রিয় শিল্পীর কণ্ঠবৈশিষ্ট্যের প্রায় নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন জগন্নাথ বসু ু “রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের ভরাট কণ্ঠস্বরে রোম্যান্টিক অভিনয়, নির্মলকুমারের স্মার্ট উচ্চারণ, সুন্দর বাচনভঙ্গি, শেখর চট্টোপাধ্যায়ের জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরে খলনায়কের পার্ট, নীলিমা দাস ও কণিকা মজুমদারের মানসিক টানাপড়েনের অনবদ্য চরিত্রায়ণগুলো আজও সজীব হয়ে আছে মনে।... নীলিমা দাসের গলায় ছিল বিষাদ, রোমান্টিকতা, আভিজাত্য, গভীরতা, অন্যদিকে লাস্যময়ী ঝুমুরওয়ালির ভাবসাবও।... গলা দিয়ে বিভিন্ন বয়স, মুড প্রকাশ করাটা শ্রীমতী দাসের কাছে সবসময়ই থ্রিলিং ব্যাপার।... মঞ্জু দে আর বিনতা রায়ের পরিশীলিত বাচনভঙ্গি, ব্যক্তিত্ব আর বুদ্ধিদীপ্ত ভাবটা ছিল বেশি। শ্রীমতি দে-র প্রতিটি সংলাপ উচ্চারণ স্বাভাবিক, অর্থবহ।... পরিশীলিত উচ্চারণ ও সুকণ্ঠের জন্য খ্যাতি ছিল অনুভা গুপ্ত-র।... বনানী চেীধুরী (র)... কণ্ঠেও ছিল আভিজাত্য। সবিতা বসু’র গলার আদুরে ভাব, বাসবী নন্দীর স্নিগ্ধতা, মীনাক্ষি গোস্বামির ব্যক্তিত্ব, শিপ্রা মিত্রের খসখসে অল্প ধরা ধরা ভাব,... শেফালি দে, মিতা চট্টোপাধ্যায়ের উচ্চারণে আঞ্চলিক ভাষা প্রাণবন্ত হয়ে উঠতো।...”
    আর আমাদের টাঙ্গাইলের জয়শ্রী সেন, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ নাটকে কুবের-ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপরীতে তাঁর সেই কপিলা’র “হেই মরদ...”, তারপর বুকের রক্তে আগুন ধরানো খলখলে হাসি? জগন্নাথ বসু ঠিকই লিখেছেন, “জয়শ্রী সেনের ফিসফিসিয়ে বলা প্রলুব্ধকারী সংলাপ...”। আর তাঁর ঊর্মিমালা সম্পর্কে - “বিবিধভারতী থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে বেতার অভিনয়ে পরিণত হয়েছেন ঊর্মিমালা। কণ্ঠ ও বাচনভঙ্গিমাকে এক লহমায় বদলে ফেলে তিনি নানান ধরনের চরিত্রে সাবলীল হয়েছেন।”


sazzadqadir@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন