শনিবার, ১৯ মে, ২০১২

না বাবা, না!

একটা সময় ছিল যখন রাজনীতিকদের মুখের ভাষার মতো তাদের পরনের জামা-কাপড়ও ছিল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এ নিয়ে একটা ছড়াও জনপ্রিয় ছিল তখন- ‘জনতা আমার হার্ট, পতাকা আমার শার্ট’। তাদের জীবন ছিল রাজনৈতিক তৎপরতায় যেমন কর্মময়, তেমন সংঘাত ও উত্তেজনাপূর্ণ। মাইক-মঞ্চ ভাঙচুর, প্রতিপক্ষের হামলা, পুলিশের লাঠিপেটা, মামলা, কারাভোগ- এসব ছিল রাজনীতিকদের জন্য পুষ্পচন্দন। পাশাপাশি রিলিফের কম্বল-গম, লাইসেন্স-পারমিট, টেন্ডার, চাঁদা, হুন্ডা-গুন্ডা, তদবির, কমিশন, কালো টাকা, কালো বিড়াল ইত্যাদিও শিরোভূষণ হয়েছে তাঁদের। এখন চিত্র পালটেছে অনেক। নেতানেত্রীদের ধারেকাছে যাওয়া সম্ভব হয় না সাধারণ মানুষের পক্ষে। হাতা-চামচারাই তাদের আগলে রাখে সবসময়। পাজেরো-নোয়া হাঁকিয়ে তারা জনসভায় আসেন, সোজা গিয়ে মঞ্চে ওঠেন, ভাঙা রেকর্ড বাজান গলা ফাটিয়ে, তারপর আবারও পাজেরো-নোয়া হাঁকিয়ে চলে যান জনতার মুখে ধুলো ছুড়তে-ছুড়তে। থাকেন অভিজাত গুলশান-বারিধারায়। হাই-ফাই লাইফ। এমনিতে ফিটফাট চমৎকার সব কিছু। ক্ষমতা গেলেও কানেকশন যায় না, কালেকশন-ও থাকেই। মুশকিল হয় যখন আন্দোলন এসে পড়ে। তখন মফস্বলে গিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে না, রাজপথে গ্যাস-লাঠি খেতে মন চায় না, আর হাজতবাস-কারাবাস? অনশন-পদযাত্রা? না বাবা, না। এসি, ফ্রিজ, হোম থিয়েটার লালিত-পালিত জেট-সেট জীবনে নাদুসনুদুস হয়ে পড়া শরীরে কি আর সইবে ও সব? নেলসন মানদেলা’র কারাজীবনের কাহিনী বলে মুখে তুবড়ি ছোটানো যায়, নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করে ভেঙে সব লোপাট করা যায়- কিন্তু কারাদুর্ভোগ মোকাবেলা? দিনের পর দিন অনশন? পদযাত্রা? না বাবা, না। য পলায়তি স জীবতি। সেটাই রাজনৈতিক কৌশল।
পৃথিবীর সকলের কাছে সকল কাজের পক্ষেই যুক্তি আছে, আর রাজনীতিতে তো শেষ কথা বলে কিছু নেই। সে কাজে প্রয়োজনমতো যা কিছু বলা যায়, আবার ঠেকায় পড়লে তার উলটো কাঁদুনি-ও গাওয়া যায়। এজন্য রাজনীতিকরা কখনও সিক্ত হন পুষ্পবৃষ্টিতে, আবার কখনও ক্ষতাক্ত রক্তাক্ত হন ইট-পাটকেলে। কখনও তাঁদের মাথায় তুলে নাচে জনতা, কখনও আবার জনতার ধাওয়া খেয়ে তাদের হতে হয় দৌড় সালাউদ্দিন। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘কাজের চেয়ে প্রতিশ্রুতি বড়। সবসে বড়া রাজনীতি। নীতি মানে নিয়ম বা নিষ্ঠা নয়, ক্ষমতা অধিকারের শক্তি। সেই শক্তি হলো বক্তৃতা। বক্তৃতা হলো শব্দের সমষ্টি। শব্দই ব্রহ্ম।’ এই ‘প্রতিশ্রুতিশীল’ রাজনীতি সম্পর্কে সোভিয়েত নেতা নিকিতা সেরগেয়েভিচ খ্রুশচেভ (১৮৯৪-১৯৭১) একবার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে নির্বাচন হয় ব্যালট বক্সের মাধ্যমে। সে নির্বাচনে ভোটের জন্য প্রচার চালাতে হয় জোরেশোরে। ভোটদাতাদের খুশি করার জন্য প্রার্থীরা দেন নানারকম আকর্ষণীয় প্রতিশ্রুতি। এ রকম এক প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে বলেন, আপনারা যদি আমাকে ভোট দিয়ে জেতান তাহলে এলাকায় আমি স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল করবো। রাস্তা পাকা করবো। জনতা বলে, এসব তো অমুক প্রার্থী করবে বলে গেছে। আপনি অন্য কি করবেন তা-ই বলুন? তখন সেই প্রার্থী বলেন, এলাকায় আসতে গিয়ে দেখলাম কোথাও কোনও ব্রিজ নেই। তাই আমি কথা দিচ্ছি, নির্বাচনে জেতার পর আমার প্রথম কাজ হবে এলাকায় একটি ব্রিজ তৈরি করা। জনতা বলে, কোথায় ব্রিজ তৈরি করবেন? এ এলাকায় কোনও নদী নেই। প্রার্থী দমেন না। বলেন, তাতে কি? প্রয়োজনে আগে নদী খুঁড়বো, তারপর ব্রিজ করবো।’
রাজনীতিতে এক দলকে কারাগারে পাঠিয়ে আরেক দল ভাবে দমন-নির্যাতন চালালেই ঢিঢ হবে প্রতিপক্ষ। কিন্তু তারা জানেন না, প্রতিপক্ষ ঢিঢ হওয়ার চেয়ে বেশি হয় দমন-নির্যাতন বিশেষজ্ঞ। সেই বিশেষ জ্ঞান তারা যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করেন ক্ষমতাসীন হওয়ার পর। গত চল্লিশ বছর ধরে এভাবেই দল, সরকার, প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য, দুর্নীতি, দুরাচার ইত্যাদি শিক্ষাগ্রহণ ও প্রয়োগকরণ চলছে একাক্রিমে। ওদিকে যে দল কারাগারে যেতে ভয় পায় তারা আবার জানেন না- তাদের যারা কারাগারে পাঠান তারাও আছেন এক ঘোরতর কারাগারে। সে কারাগার প্রতিশ্রুতির। তারা শ’ শ’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নির্বাচনের আগে। সেগুলোর বাস্তবায়ন কতখানি কি করেছেন ক্ষমতাসীন হয়ে- সে সব প্রশ্ন তুলে তাদেরও তারা রাখাতে পারেন জনতার নিত্য কারাগারে। তখন তারাও কানে আঙুল দিয়ে বলতে চাইবেন- না বাবা, না!
sazzadqadir.rediffmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন