বৃহস্পতিবার, ৩১ মে, ২০১২

সাংবাদিক তো হইছে কি?

তখন তদারক সরকারের আমল। রাস্তার এখানে-ওখানে চেকপোস্ট। আমাদের গলায় চেইন, তাতে ‘সাংবাদিক’ বা ইংরেজিতে ‘প্রেস’ লেখা কার্ড আটকানো। সে কার্ড ঢুকিয়ে রাখি বুক পকেটে। জায়গামতো আবার  ঝুলিয়েও রাখি ওই পকেট থেকে বের করে।
    কি কাজে গিয়েছিলাম উত্তরায়। ফিরছি সিএনজি চালিত বেবি ট্যাকসিতে। ফার্মগেটের ওখানে পুলিশের এক জিপ পেছন থেকে দু’-একবার টুক-টুক গুঁতো দেয়ার পর জোরেই দেয় ধাক্কা। আমি ছিটকে উঠি, আমার চশমা পড়ে যায় কোথায়, কানের কাছে মাথায় লাগে বেশ চোট। বেবি ট্যাঙি চালক জোরে ব্রেক কষেন, আবারও উঠি ছিটকে। এবার বেরিয়ে পড়ি বাইরে, চালকও আসেন বাইরে। জিপের চালকের অবশ্য ভ্রূক্ষেপ নেই কোনও, জোরে-জোরে কড়া হর্ন দিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন জটাক্রান্ত গাড়িগুলিকে। চালকের পাশে বসে থাকা পুলিশ আমাদের দেখে এগিয়ে আসেন, আমাকে ‘আঙ্কেল’ বলে দুঃখ প্রকাশ করেন, প্রকৃত দুঃখিত ও স্বরে আরও দু’চারটে কথা বলেন, তাঁর ব্যবহারে আমি পানি হয়ে যাই একেবারে। এই সময়ে আমার পকেট থেকে বেরিয়ে পড়া লাল ইংরেজি অক্ষরে ‘প্রেস’ লেখা কার্ডটি দেখে ফেলেন চালক, দেখেই চেঁচিয়ে ওঠেন, “এমুন কইরা ধাক্কা দিলেন? উনি একটা সাংবাদিক, কিছু একটা হইতো যদি?” আর যায় কোথা! সঙ্গে-সঙ্গে মুখ চোখ চেহারা কণ্ঠ ভঙ্গি বদলে যায় পুলিশের। রেগে ক্ষেপে চিৎকার করে ওঠেন, “সাংবাদিক! আমার গাড়িতেও ম্যাজিস্ট্রেট আছে! সাংবাদিক তো হইছে কি!” তাকিয়ে দেখি ম্যাজিস্ট্রেট গোছেরই এক চেহারা, আমার অর্ধেক বয়সী হবে, বসে আছেন নির্বিকার।
    পুলিশের আকস্মিক ভাবান্তরে কিছুটা হতভম্বই হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। হওয়া অবশ্য উচিত হয় নি। নানা কাজে ও ঘটনায় পুলিশের কাছে যেতে হয়েছে, তাদের সঙ্গে কাজও করতে হয়েছে, কিছু ব্যতিক্রম বাদে তাদের কাছ থেকে যথেষ্ট আদর-সমাদরই পেয়েছি। একাত্তরে হানাদার বাহিনীর ডেথ ক্যাম্পে শহিদ নামের যে রাজাকার কমান্ডার আমার ওপর নৃশংস নির্যাতন চালিয়েছিল, আশির দশকের গোড়ার দিকে  পুলিশ কর্মকর্তা নবাব আলী (শওকত মাহমুদের ভগ্নিপতি)-ই খুঁজে পেয়েছিলেন তাকে। তারপর আমার কথা মনে করিয়ে দিয়ে, হাতেনাতে তাকে উপযুক্ত যত্ন করতে তিনি ভোলেন নি একটুও। বর্তমান আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার যখন টাঙ্গাইলের এসপি ছিলেন তখন এক ঈদ দিনের আপ্যায়নে তাঁর সমাদরের কথা ভুলি নি এখনও। সে আপ্যায়নে আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা থেকে বেড়াতে যাওয়া আরও একজন পুলিশ কর্মকর্তা নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা ও চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেল।
সেই সাপ্তাহিক বিচিত্রা, দৈনিক সংবাদ থেকে এই দৈনিক মানবজমিন-এ কত সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় লিখেছি পুলিশকে নিয়ে। দু’একজনের কুকর্মের জন্য গোটা পুলিশ সমাজকে দায়ী করতে যাই নি কখনও। যে পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় পুলিশি জুলুমের খবর ছাপা হয়, দেখা যাবে তার ভেতরের পৃষ্ঠায় ‘চিঠিপত্র’ বিভাগে ছাপা হয়েছে ‘পুলিশ ফাঁড়ি চাই’ শিরোনামের আবেদন। পুলিশের নানা বাড়াবাড়িতে কঠোর সমালোচনা করেও রাতে যে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যাই তার কারণ তো তোলপাড় ঝড় জল বৃষ্টি বা কনকনে শীত বা গনগনে গরমে ওঁরা বাইরে  জেগে থাকেন, পাহারা দেন রাস্তায়-রাস্তায় - পাড়ায়-পাড়ায়। কবি অজিত দত্ত (১৯০৭-১৯৭৯) লিখেছেন, “নিশীথ রাত্রে নিদ্রিত ধরার প্রতিনিধি পুলিশ একাকী জাগে রোজ।” ভ্রমণোপন্যাসিক অবধূত (১৯১০-১৯৭৮)  লিখেছেন, “... যাদের হুকুমে পুলিশ লাঠি চালায় - তারা দায়ী নয়, দায়ী হতে গেল কুড়ি টাকা মাইনের চাকরগুলো!” কথাসাহিত্যিক আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩) লিখেছেন, “দারোগা বলে যত ঠাট্টাই করুক, ঠেকায় সকলকেই দারোগার দ্বারস্থ হতে হয়।” সতীনাথ ভাদুড়ী (১৯০৬-১৯৬৫)-ও লিখেছেন, “পুলিশ নিমকহারাম নয়; - যার নুন খায় তার গুণ গায়।” তবে সবাই সমর্থন করতে পারেন নি অত। কথাসাহিত্যিক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯৬৬) লিখেছেন, আইন তো পুলিশের হাতের খেলনা মাত্র! কথাশিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) লিখেছেন, পুলিশ সাপ হয়ে দংশায়, রোজা হয়ে ঝাড়ে। সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮) প্রশ্ন করেছেন, পুলিশ কি পাপ অন্যায়ের ধার ধারে? সাহিত্যিক-চলচ্চিত্রকার প্রেমাঙ্কুর আতর্থী (১৮৯০-১৯৬৪)-র লেখায় বিস্ময়-প্রশ্ন, “পুলিশে চাকরি করো বলে কি মানুষের চামড়া তোমার গায়ে নেই!” সবচেয়ে কড়া কথাটি রবীন্দ্রনাথই লিখেছেন, “পুলিশ একবার যে চারায় অল্পমাত্রও দাঁত বসাইয়াছে সে চারায় কোনও কালে ফুলও ফোটে না, ফলও ধরে না। উহার লালায় বিষ আছে।” (‘ছোটো ও বড়ো’)
১৯৮৩ সালে এক পুলিশ কর্মকর্তা আমার সাংবাদিক পরিচয় জেনে ‘খালাতো ভাই’ বলেছিলেন আমাকে। জিজ্ঞাসা করায় বলেছিলেন, “আর ক’ মাস পর অবসরে যাবো। পুলিশের চাকরি করে সবই দেখলাম। আমাদের ওপর দায়িত্ব - আদালতে যাতে সুবিচার হয় তার যোগাড়যন্ত্র সব ঠিকঠাক করা। আমরা তা করি না। আপনাদের ওপর দায়িত্ব সত্য কথা লেখার। আপনারা তা লেখেন না। জনগণ আমাদের উভয়কেই ঘৃণা করে!”
sazzadqadir@rediffmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন