বৃহস্পতিবার, ৭ জুন, ২০১২

ফররুখ আহমদ: নিবেদিত কবিতা

কবিকে প্রেরণা যোগায় জীবন ও প্রকৃতি। বহমান কাল ভাবিত রাখে তাঁকে। আস্থা তাঁর পরম্পরায়। তাই যুগ-যুগান্তের কবিতা সংলগ্ন থাকে বোধে, চেতনায়। এভাবে কবিতার সঙ্গে পূর্বসূরি কবি-ও থাকেন তাঁর অন্তরাসীন। নিবেদিত কবিতায় সে অনুরাগের স্বীকৃতি ঘোষণা করেন কবি, নিজের শিল্পভাবনাও প্রকাশ করেন সেই সঙ্গে। যুগসন্ধির কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) অনুরক্ত ছিলেন নবদ্বীপের রাজসভাকবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর (১৭১২-১৭৬০) থেকে ইংরেজ ব্যঙ্গ-কবি আলেকজানডার পোপ (১৬৮৮-১৭৪৪) পর্যন্ত অনেকের। বিশেষ কোনও কবিকে কোনও কবিতা নিবেদন না করলেও তাঁর কবি ও কবিতা বিষয়ক ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে ‘কবি’ শীর্ষক কবিতায় - “কবির বর্ণনে দেখি ঈশ্বরীয় লীলা। ভাব-নীরে স্নান করি দ্রব হয় শিলা ॥ তুলারূপে দৃষ্ট হয় ধন আর মন। ভাবরসে মুগ্ধ করে ভাবুকের মন ॥ রসিকজনের আর নাহি থাকে ক্ষুধা। প্রতি পদে বর্ণে বর্ণে কর্ণে যায় সুধা ॥ জগতের মনোহর ধন্য ভাই কবি। ইচ্ছা হয়, হৃদিপটে তুলি তোর ছবি ॥”
    নিবেদিত কবিতার ক্ষেত্রে আদর্শ স্থাপন করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)। সমকালীন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ছাড়াও সেকালের কীর্তিধন্য কবিদের উদ্দেশে কবিতা নিবেদন করেছেন তিনি। কাশীরাম দাস, কৃত্তিবাস, জয়দেব, কালিদাস, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, দানতে, আলফ্রেড টেনিসন, ভিকতর উগো, বাল্মীকি প্রমুখকে নিবেদিত তাঁর কবিতা কেবল শ্রদ্ধা নিবেদন বা প্রশস্তি নয়, তাঁদের কীর্তির মূল্যায়নও করেছেন প্রসঙ্গক্রমে। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ও ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের প্রতি সরাসরি না হলেও তাঁদের সৃষ্টির সার্থকতাকে কবিতায় তুলে ধরেছেন মধুসূদন। রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধ-নিবন্ধে অনেক কবি-সাহিত্যিককে স্মরণ করলেও তাঁর নিবেদিত কবিতার সংখ্যা মাত্র তিন। এর মধ্যে কালিদাসের প্রতি নিবেদিত কবিতায় আছে তাঁর একাত্মতার অনুভব, আর অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭৪-১৯৩৪) ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২)-কে নিবেদিত কবিতা দু’টি আসলে মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ। অবশ্য ‘বৈষ্ণব কবিতা’য় তিনি বিশেষভাবে মূল্যায়ন করেছেন মহাজন-পদকর্তাদের। কাজী নজরুল ইসলামের নিবেদিত কবিতা ‘সত্য-কবি’ ও ‘সত্যেন্দ্র-প্রয়াণ-গীতি’-ও কবি সত্যেন্দ্রনাথের দত্তের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ। রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত তাঁর ছ’টি কবিতার দু’টিই এ ধরনের  শোকপ্রকাশমূলক।
    বাংলা কবিতায় ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪) যাঁর কীর্তিমান উত্তরসূরি, যাঁর ধীরোদাত্ত ভাষা ও দার্ঢ্য মহিমাকে নিজস্ব ভাব-ব্যঞ্জনায় তিনি অন্যলোকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেই মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিবেদিত কোনও কবিতা তাঁর নেই। তবে অনুসৃতি আছে তাঁর কবিতাদর্শের। নিবেদিত কবিতায় তিনিও মাইকেলের নিবেদিত কবিতার মতোই শ্রদ্ধা নিবেদন ও প্রশস্তির পাশাপাশি তাঁদের কবিকীর্তির মহিমাকে তুলে ধরেছেন, স্বীকৃতি জানিয়েছেন তাঁদের ঐতিহ্যের অংশীদার হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করে। অবশ্যই দু’জনের অংশীদারিত্বে ভিন্নতা আছে। মধুসূদন ঐতিহ্যসূত্র খুঁজেছেন ইউরোপে ও বাংলা-ভারতে, ফররুখ খুঁজেছেন মধ্যপ্রাচ্যের ফারসি ও বাংলার পুঁথি-সাহিত্যে। তাঁর কবিতা নিবেদিত হয়েছে ফেরদৌসী, রুমি, জামি, সাদি, হাফিজ ও শাহ গরীবুল্লাহকে। দিওয়ানা মদিনা, শহিদে কারবালা, তাজকেরাতুল আউলিয়া, কাসাসুল আমবিয়া, আলিফ লায়লা, শাহনামা, চাহার দরবেশ, হাতেম তায়ী প্রভৃতি পুথি, গীতিকা ও লোকসাহিত্যের উদ্দেশ্যে রচিত কবিতাগুলিও আসলে রচয়িতাদের প্রতি নিবেদিত। এই নিবেদন বিচ্ছিন্ন কোনও কাব্যপ্রয়াস নয়, তাঁদের কাব্যভাবনা ও শিল্পবীক্ষারই প্রকাশ।
    কবিতা কি? মধুসূদন লিখেছেন, “মনের উদ্যান-মাঝে কুসুমের সার কবিতা-কুসুম-রত্ন” (‘কবিতা’)। আরও লিখেছেন, কবিতায় যার মন মজে না সে এক ঘোরতর দুর্মতি। বিজ্ঞজনকেই তাই তুষ্ট করতে চেয়েছেন তিনি কবিতার মাধ্যমে। আর কবি কে? মধুসূদনের মতে, তিনিই কবি “কল্পনা সুন্দরী যার মনঃ-কমলেতে পাতেন আসন,” অস্তগামী সূর্যের সোনালি কিরণের যে আভা অমন রূপ প্রকাশ পায় যার “ভাবের সংসারে” (‘কবি’)। ফররুখ আহমদ-ও কবিতাকে বলেছেন, হৃদয়ে জেগে থাকা স্বপ্ন (‘কবিতার প্রতি’)। আরও বলেছেন, জীবনে জন্ম নেয়া রক্তদল (‘দুর্লভ মুহূর্ত’)। তাঁর কাছে কবিতা মুহূর্তের কলতান, কিন্তু আবেদন তার কালজয়ী (‘মুহূর্তের কবিতা’)। তাই মধুসূদন যে মহৎ কল্পনা ও মহৎ ভাবের কথা বলেছেন ফররুখ আহমদের কাছে কবিতা তারও বেশি কিছু। কবির অপরাজেয় সত্তার চিরভাস্বর রূপই কবিতা। তিনি লেখেন ‘কবির প্রতি’ -
    “বজ্র বিদ্যুতের বাসা যে আকাশ, তুমি সে আকাশে, তুমি সে আকাশে
    সহজে নিয়েছ তুলি পাদপিষ্ট ধূলিকণিকারে,
    তারার ঔজ্জ্বল্যে দীপ্ত মহিমায় সাজায়েছ তারে
    যে সত্তা অপরাজেয় তারে মূর্ত করেছ বিশ্বাসে।...”
    কবিতাই পারে ‘পাদপিষ্ট’ জনকে অত্যুচ্চ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে। নিবেদিত কবিতায় এই বিশ্বাসকে, এই বিশ্বাসের প্রতি সমর্থনকেই শিল্পিত রূপ দিয়েছেন ফররুখ আহমদ। পূর্বসূরিকে নিবেদিত কবিতায় লিখেছেন -
    “...কত তন্দ্রাহীন রাত্রি কেটেছে তোমার নিরলস,
    শ্রান্তিহীন দিনগুলি কেটে গেছে একাগ্র তোমার
    তিক্ততম সাধনায়। পেয়েছো বিদ্রূপ উপেক্ষার,
পেয়েছো লাঞ্ছনা, ঘৃণা, সুনির্মম, বিস্বাদ, বিরস!
চাও নি সুলভ খ্যাতি (সন্ত্রস্ত করে নি অপযশ)
তোমাকে মর্যাদা দিয়ে পাই আমি পাথেয় আমার ॥”
মধুসূদন-ও একই ভাবে স্মরণ করেছেন - মর্যাদা দিয়েছেন মৃত্যুর পর কয়েক বছরের মধ্যেই বিস্মৃত, উপেক্ষিত ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে -
“...নাহি কি কেহ তব বান্ধবের দলে,
তব চিতা-ভস্মরাশি কুড়ায়ে যতনে,
স্নেহ-শিল্পে গড়ি’ মঠ, রাখে তার তলে?
আছিলে রাখাল-রাজ কাব্য-ব্রজধামে
জীবে তুমি; নানা খেলা খেলিলা হরষে;
যমুনা হয়েছ পার; তেঁই গোপগ্রামে
সবে কি ভুলিল তোমা’?...”
ফারসি মহাকাব্য ‘শাহনামা’র কবি হাকিম আবু’ল-কাসিম ফেরদৌসি তুসি (৯৪০-১০২০) নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে। কিন্তু অমর হয়ে আছে তাঁর সৃষ্টি। ফররুখ আহমদ লিখেছেন:
“... শতাব্দীর অন্ধকার দীর্ণ করি’ তাই জেগে আছে
তোমার মহৎ কাব্য অম্লান আভায় জীবনের,
মিশেছে তাজ ও তখত কায়কোবাদ-কায়কাউসের
তোমার অরণ্য তবু সজীব, শ্যামল চারাগাছে,
তোমার প্রতিভা-দীপ্তি মানে নাই শতাব্দীর ঘের
আজও সে বিলায় দ্যুতি দূরতম নক্ষত্রের কাছে ॥”
ফারসি কাব্য ‘হফত আওরঙ্গ’, ‘তুহফাত আল-আহরার’, ‘লায়লা ওয়া-মজনুন’, ‘ফাতিহাত আল-শাবাব’, ‘লাওয়া’ইহ’ ও ‘আল-দুররাহ আল-ফকিরাহ’র রচয়িতা নূর আদ-দিন আবদ আর-রহমান জামি (১৪১৪-১৪৯২)-কে নিবেদিত কবিতায় ফররুখ আহমদ তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “সত্যান্বেষী প্রাণ যার ঘূর্ণিঝড়ে, রাত্রির তুফানে তুমি সে প্রেমিক সুফি”। আরও বলেছেন, “প্রেমিক আশিক তুমি অফুরন্ত তোমার সঞ্চয় / ভাবের সমুদ্র থেকে দিলে এনে বাণী এ সত্যের...”। এই সত্য ও সুন্দরের প্রসঙ্গ তিনি তুলে ধরেছেন ফারসি কাব্য ‘মসনবি’, ‘দিওয়ান-ই শামস-ই তাবরিজি’ ও ‘ফিহি মা ফিহি’ প্রণেতা জালাল আদ-দিন মুহাম্মদ রুমি (১২০৭-১২৭৩)-কে নিবেদিত কবিতায়ও। লিখেছেন: “... সত্যের নিগূঢ় বার্তা প্রাণকেন্দ্রে যার সংগোপন / (দুস্তর তরঙ্গ ঊর্ধ্বে, মর্মে তার মোতির ভা-ার), / মানে নি, মানে না মানা সত্যাশ্রয়ী, - মিথ্যার বন্ধন; / খুলে দেয় প্রয়াসীকে অফুরন্ত রহস্যের দ্বার।...” ফারসি ভাষায় রুমি যে যুগান্তর আনেন তা-ও বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছেন তিনি। ফারসি ‘গুলিসতাঁ’ ও ‘বুসতাঁ’র কবি আবু-মুহাম্মদ মুসলিহ আল-দিন বিন আবদাল্লাহ শিরাজি (১১৮৪-১২৮৩), যিনি সা’দি নামে সমধিক পরিচিত, তাঁকে নিবেদিত কবিতায় তাঁর কাব্য সৌন্দর্য, প্রেম ও প্রজ্ঞার প্রশস্তি রচনা করেছেন ফররুখ আহমদ - “... সব মৌসুমের শস্য তুলে নিলো যে তার ভা-ারে, / বিশ্বের গুলিস্তাঁ থেকে কুড়ালো যে ফুলের ফসল / জ্ঞানী সে, মরমী জন, প্রেমপন্থি;... সে চির উজ্জ্বল / নিঃস্বার্থ ত্যাগে সংখ্যাহীন প্রাণের দুয়ারে।...” ফারসি ‘দিওয়ান’-এর কবি খাওয়াজা শামসু দ-দিন মুহাম্মদ হাফেজ-ই শিরাজি (১৩২৫-১৩৮৯)-কে তিনি বলেছেন কানন মুখর করা মৃত্যুহীন বুলবুল। তাঁর ‘দিওয়ান’, গজলকে বলেছেন ‘অমর গীতিকা’। এ গীতিকা অনন্য হয়েছে ভাব ও ভাষার অপূর্ব সম্মিলনে।
কাব্যভাষা-চিন্তা সবসময়েই ছিল ফররুখ আহমদের। মুখের ভাষাকে সাহিত্যের ভাষার ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার চিন্তা করতেন তিনি। সেই চিন্তা থেকেই তিনি ঐতিহ্যের সন্ধান করেছিলেন সতের-আঠারো শতকের পুঁথি-সাহিত্যে। এ সাহিত্যের ‘শ্রেষ্ঠ কবি’ শাহ মুহম্মদ গরীবুল্লাহ (১৮ শতক)-কে নিবেদিত কবিতায় তিনি ‘জীবন্ত ভাষা’ বলেছেন পুঁথির ভাষাকেই:
“... জীবন্ত ভাষার স্রোতে ভেসে গেল কোথায় তখন
মৃত ভাষা (গুরুতর সংস্কৃতের শিখা জগদ্দল)!
সিন্দাবাদ জাহাজীর স্কন্দ হতে জয়ীফ যেমন
জমিনে লুটায়ে পড়ে দিলো ছেড়ে বাধার অর্গল;
চঞ্চল ঝর্নার মতো প্রচলিত ভাষার উচ্ছল
গতিতে উন্মুখ হলে রসান্বেষী জনসাধারণ ॥”
‘চলতি ভাষার পুঁথি’ শীর্ষক কবিতায় এ ভাষাকে ‘জীবন্ত মাতৃভাষা’ ও ‘জীবনের ভাষা’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি:
“... দুঃসহ দুঃখের পালা শেষ হলো একদা, যেদিন
মুক্তি পেলো জীবনের ভাষা, আর নিরুদ্ধ জবান
জিন্দানের রাত্রিশেষে পেলো খুঁজে রোশনি অমলিন;
আড়ষ্ট প্রহর শেষে যেন সে উচ্ছল বহমান
কূলপ্লাবী নদী এক পূর্ণতার পথে সুরঙিন
জীবন্ত ভাষায় দীপ্ত পরিপূর্ণ যৌবনের গান ॥”
বস্তুত এককালে পুঁথির বিপুল পাঠকপ্রিয়তার মূলে ছিল এর ভাষা। এ ভাষা ছিল বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি। ওই ভাষা-পরীক্ষার সূত্রেই মানবতার কবি হয়েও ‘ইসলামী ঐতিহ্যবাদী’ চিহ্নিত হয়ে যান ফররুখ আহমদ। তবে তাঁর পরীক্ষার বাস্তব ভিত্তি ছিল, তাই একেবারে নিস্ফল হয় নি তা। এখনকার নবীন লেখকদের ভাষায় নানাভাবে ওই একই পরীক্ষা-নিরীক্ষা লক্ষ্য করি, এর পাঠকপ্রিয়তারও ক্রমবৃদ্ধিও লক্ষ্য করি।
facebook.com/sazpa85

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন