বৃহস্পতিবার, ৭ জুন, ২০১২

এক মন্ত্রী, তাঁর পিএস

শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮৬-১৯৭১) ছিলেন কুমিল্লার খ্যাতিমান আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ।  যুক্ত ছিলেন ইনডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস-এর সঙ্গে, পরে ১৯৫৪ সালে গঠন করেন ‘গণসমিতি’ নামে এক রাজনৈতিক দল। আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে গঠিত পূর্ববঙ্গ সরকারের মন্ত্রীসভায় তিনি ছিলেন মেডিক্যাল, পাবলিক হেলথ ও সোস্যাল ওয়েলফেয়ার মন্ত্রী (সেপটেম্বর ১৯৫৬ - অকটোবর ১৯৫৮)। তার প্রাইভেট সেক্রেটারি (পিএস) ছিলেন আবদুল ওহ্‌হাব (১৯০৪-১৯৯০)। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আগে তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী নীল মিঞা ও মনোরঞ্জন ধরেরও প্রাইভেট সেক্রেটারি ছিলেন অল্প কিছু দিনের জন্য। তখন মন্ত্রীসভার গঠন ও পতন ঘটছিল ঘন-ঘন। মৃত্যুর প্রায় ২২ বছর পর সম্প্রতি আবদুল ওহ্‌হাবের স্মৃতিকথা “একজন মুসলমান বাঙালির জীবনস্মৃতি” (জাগৃতি প্রকাশনী, ঢাকা; পৃষ্ঠা ১৮২; মূল্য ৳ ৩০০.০০) প্রকাশিত হয়েছে পুত্র মো. শাহাবুল আলমের উদযোগে। বইটির ১৭ পৃষ্ঠা জুড়ে (১১০-১২৬) রয়েছে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে তাঁর দু’ বছরের নানা অভিজ্ঞতার বিবরণ। সে জীবনের শুরুটা এ রকম - আবদুল ওহহাব লিখেছেন:
    “... ধীরেন্দ্র বাবু কুমিল্লার এডভোকেট। আমার শ্বশুর খাঁন বাহাদুর ফরিদউদ্দিন সাহেবও কুমিল্লার এডভোকেট। সুতরাং উভয়েই বন্ধু। তবে ধীরেন্দ্র বাবু বয়সে বড়। দুইজনই বহুদিন রাজনীতি করেছেন। ধীরেন্দ্র বাবু কংগ্রেসি আর আমার শ্বশুর মুসলিম লীগের।
    ধীরেন্দ্র বাবু মন্ত্রী হিসেবে অফিসে আসার প্রথম দিনেই আমি গিয়ে দাঁড়ালাম দোতলার সিঁড়ির কাছে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই দিলাম তাঁকে সালাম, আর বললাম, স্যার, আমি আপনার প্রাইভেট সেক্রেটারি। এটির চেয়েও বড় কথা হলো, আমি কুমিল্লার হুমায়ূন সাহেবের জামাই।
    এই কথা শুনে তিনি হাসলেন আর বললেন, তাহলে তো আপনি আমাদের আপন লোক।...”
    এ ঘটনা ১৯৫৬ সালের। তখন পাকিস্তান আমল। এখন এই ৫৬ বছর পর, ২০১২ সালে, স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক আমলে ভাবুন তো দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের দুই নেতার মধ্যে এমন বন্ধুত্ব - এক দলের মন্ত্রীর পিএস আরেক দলের নেতার মেয়ের জামাই?
    আবদুল ওহ্‌হাবের ‘জীবনস্মৃতি’ থেকে উদ্ধৃত করার মতো ঘটনা অনেক, যা আজকের পরিপ্রেক্ষিতে রূপকথাই মনে হবে অনেকের কাছে। কৌতূহলী পাঠকেরা সে সব ‘রূপকথা’র খোঁজ নিতে অবশ্যই বইটি খুঁজে নিয়ে পড়বেন আশা করি। পিএস-এর বর্ণনায় মন্ত্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রথম দিনের ঘটনা উদ্ধৃত করেছি, এবার শেষ দিনের ঘটনা উদ্ধৃত করে এ বৃত্তান্তে যবনিকা টানছি:
    “(মারশাল ল’ জারির খবর) শুনে সঙ্গে-সঙ্গে ছুটে গেলাম তাঁর (ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের) বাসায়। যেতেই বললেন, সেক্রেটারি সাহেব, আজ থেকেই সারা পাকিস্তানে জারি হয়েছে মারশাল ল’। আইয়ুব খান এখন পাকিস্তানের সর্বেসর্বা। আমরা আর কেউ নই মন্ত্রী।
    বলেই বললেন, দেখুন না, নেই টেলিফোন। নেই গার্ড। কুমিল্লা যেতে হবে আজই, কিন্তু যাবো কি করে? হাতে যে নেই টাকা-পয়সা।
    এমন সময় সেখানে এলেন পাবলিক হেলথের চিফ ইনজিনিয়ার লতিফ সাহেব। বললেন তাঁকে, কি করে মালপত্র নেবো স্টেশনে?
    লতিফ সাহেব বললেন, সে জন্য ভাববেন না, স্যার। আমরা আছি কি করতে?
    লতিফ সাহেব বন্দোবস্ত করলেন গাড়ির। ধীরেন্দ্র বাবু বাড়ির সব লোকজনকে নিয়ে চললেন স্টেশনে। আমিও চললাম সঙ্গে।
    স্টেশনে যাওয়ার পর তিনি বললেন একজনকে, একখানা ইনটার ক্লাশের টিকেট করে আন।
    এ কথা শুনে আমি দিলাম বাধা। বললাম, না, তা কিছুতেই হয় না। আপনাকে অন্ততপক্ষে যেতে হবে ফার্স্ট ক্লাশে।
    বললেন তিনি, ফার্স্ট ক্লাশের ভাড়া পাবো কোথায়?
    দুঃখের বিষয় আমার সঙ্গেও ছিল না বেশি টাকা-পয়সা। তাই আমাকে থাকতেই হলো চুপ। তবুও শেষ পর্যন্ত তাঁকে করে দেয়া হলো একখানা সেকেন্ড ক্লাশের টিকেট। অন্যরা গেলেন ইনটার ক্লাশে।...”
    এ রচনার শিরনামা পড়ে যাঁরা ভেবেছিলেন কোনও কালো বিড়ালের কাহিনী পড়বেন তাঁদের নিরাশ করার জন্য দুঃখিত।

facebook.com/sazpa85
   
   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন