শনিবার, ৯ জুন, ২০১২

শাহীন রেজা’র কবিতা প্রসঙ্গে

কি বলা যায় শাহীন রেজা ও তাঁর কবিতা সম্পর্কে? আমার সামনে তাঁর দশম কাব্যগ্রন্থ ‘পাখি চলে গেলে কবি বড় একা’। এর আগের ন’টি কাব্যগ্রন্থ দেখি নি আমি, নামও জানি না সেগুলোর। শাহীন রেজাকেও আমি দেখি নি কখনও, তাঁর সঙ্গে তেমন জানাশোনাও নেই আমার। তবে পরিচয় আছে তাঁর কবিতার সঙ্গে, প্রায়ই পড়ি পত্রিকার পাতায়, নিজেও ছেপেছি কিছু। এখন তাঁর সম্পাদিত ‘বৈচিত্র’-এ কলাম লিখছি নিয়মিত। মাঝেমধ্যে হঠাৎ কখনও কথা হয় ফোনে।
    কবিতা পড়ে আমার ধারণা হয়েছিল, শাহীন রেজা’র বয়স  ২০ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। ঝকঝকে তরুণ। এখন বইয়ের শেষ প্রচ্ছদের ফ্ল্যাপ পড়ে জানলাম, আমার ধারণার চেয়ে দু’ গুণ বেশি বয়স তাঁর। ৫০। যে বছর ম্যাটরিক পাশ করে আমি কলেজে ভর্তি হই সেই ১৯৬২ সালে তাঁর জন্ম। কবিতায় অবশ্য কোনও বয়স নেই শাহীন রেজার, সময়ের চিহ্নও নেই। তবে পড়তে গেলে আমার মধ্যে জেগে ওঠে আমার ১৯-২৪ বছরের, বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের, যাবতীয় আবেগ অনুভব বিষাদ বেদনা বোধ ও চেতনার স্মৃতি। নামকবিতায় শাহীন রেজা যেমন লিখেছেন:
    “ফেলে রেখে কয়েকটি পালক চলে গেছে পাখি
    কবির উঠোন ছেড়ে... কবি তাকে দেখে না
    কোথাও... না বারান্দায়... না বৃক্ষের ডালে
    সুবর্ণ পাতার ফাঁকে... নেই নেই সে নেই
    পাখি চলে গেলে পালকেরা শুধুই স্মৃতি...”
    আর ‘সত্যনগর’ তো সব সময়ের কবিতা। চারপাশে যখন রাজলেহী ও কীর্তনিয়াদের ভিড়, তখন ক্ষতি স্বীকারে প্রস্তুত থেকে যিনি ভিন্নমত পোষণের ও সমালোচনার অধিকার সমুন্নত রাখতে পারেন তিনিই তো প্রকৃত কবি। এ কবিতা অনেকখানি আমারই কবিতা। কোনও দলে গ্রুপে গোষ্ঠীতে না থেকে, সকল আক্রমণ সহ্য করে, নিজেকে অব্যাহত রাখার আত্মনাদ এ কবিতা:
    “... চারদিকে গণিকারা যেন অজগর
    আমাকে চেয়েছে তারা ক্ষুধা ও রতিতে
    রাত্রি দিনের মাঝে তীব্র ক্ষতিতে
    আমার চেতনা কেড়ে ক্রমশ অবোধ
    চেয়েছে ছোবল দিতে যেন প্রতিশোধ...”
    তবে শাহীন রেজার মতো প্রেমে ও কামে নারীকে আমিও দেখেছি, তবে তিনি যেন বিচক্ষণ বেশি। ভালবেসে, প্রেমে পড়ে, কবিতার ভাষা ছন্দ সব ভুলভাল, তছনছ করেছি আমি, কিন্তু তা করেন নি তিনি। প্রেমে আবেগতপ্ত হলেও, কখনও বিষাদম্লান, কখনও স্মৃতিদুঃখী হলেও কবিতায় তিনি স্বস্থ। তাঁর নির্মাণ মেধান্বিত, শব্দবয়ন নিপুণ, ভাষা প্রসাধিত, অন্ত্যমিল অপ্রত্যাশিত আনন্দ জাগায়:
    “মৈথুন আনন্দে জাগি সারারাত
    আকাশের প্রপঞ্চ পাখায়
    সুখের করাত হয়ে কেটে চলি নদী-নারী
    এবং জরিনা সখিনা বেহুলার ভ্রূণ...” (‘অবগাহন’)
    “... যে নারী লবঙ্গলতা বেশবাসহীন
    অমরার দ্বার খুলে জেগে থাকে আর কামনার দীপ জ্বালে
    আমি খুঁজি তাকে সনাতন রাতে
    গণিকারা রতি করে মরা গাঙে হাঁসুলীর বাঁকে।” (‘লখিন্দর’)
    “নিজ হাতে ছিঁড়ে ফ্যালো হুক
    অন্ধকারে উদ্ভাসিত শুভ্র ডাহুক
    মাঝরাতে কাচ-চুড়ি শব্দদূষণ
    অদ্ভুত উড়ে যায় লজ্জা ভূষণ...” (‘মাঝরাতে শব্দদূষণ’)
    বইয়ের প্রথম প্রচ্ছদের ফ্ল্যাপে শাহীন রেজা সম্পর্কে বলা হয়েছে - তিনি প্রেম ও প্রকৃতির কাছে সমর্পিত। তাঁর কবিতা যেন মায়াবী জ্যোৎস্নার রাত। বর্তমানের বাস্তবতা এড়াতে কখনও-কখনও তিনি স্মৃতিবাসীও বটে। আরও বলা হয়েছে - শাহীন রেজা’র কবিতা প্রাঞ্জল, সহজ সরল জীবনবোধ ও মানবচেতনায় উজ্জ্বল। নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি নির্মাণ করেন কবিতাকে। তাঁর কবিতার উচ্চারণ সাহসী, গতি সাবলীল। এ বৈশিষ্ট্যগুলো তাঁর সমকালীনদের থেকে কতখানি স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত করবে তাঁকে তা বলা মুশকিল, কিন্তু সাঙ্কেতিক ব্যঞ্জনা সমৃদ্ধ কাব্যপঙ্‌ক্তি তাঁকে নিশ্চয়ই অলোচিত ও উদ্ধৃত রাখবে বিভিন্ন উপলক্ষে। এমন কয়েকটি পঙ্‌ক্তি উদ্ধার করছি এখানে:
    “যেদিকেই যেতে চাই মাকড়শা বসে আছে
    পেতে রেখে সময়ের জাল” (‘পথ এবং ঋতুবতী নারীদের গল্প’)
    “শালিকের দৃষ্টি থেকে ফসলেরা
    নিজেদের যেভাবে লুকায়...” (‘নীল চোখ’)
    “প্রিয় নারী প্রিয় তুমি
    সব থেকে চেনা
    তোমাকেই হবে তবু
    কড়ি দিয়ে কেনা।” (‘সরল পদ্য’)
    “ভালবাসো তাই
    হৃদ-পাত্র শূন্যে তোলে হাই।” (‘মাঝরাতে শব্দদূষণ’)
    “শহরের সবগুলো বৃক্ষ আমার নয়
    আমাকে তাই বাধ্য হয়ে ধার করতে হয় ছায়া...” (‘ছায়া’)
    এ রকম বচনবৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল পঙ্‌ক্তি ‘পাখি চলে গেলে কবি বড় একা’ থেকে উদ্ধার করা যায় আরও। ডবলিউ এইচ অডেন (১৯০৭-১৯৭৩) কবিতাকে বলেছেন ‘স্মরণীয় পঙ্‌ক্তিমালা’ - সে হিসেবে অমন অনেক পঙ্‌ক্তি রচনা করে কবি-অঙ্গীকার পূরণ করেছেন শাহীন রেজা। তিনি সম্পন্ন কবি। ভাল কবিতা রচনার আদি-অন্ত তাঁর আয়ত্তে - তাই জীবন ও জগতের আরও মহত্তর পরিসরে নতুন-নতুন নিরীক্ষায় তাঁর কবিতা উদ্ভাসিত হোক আরও - এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সলমন রুশদি’র একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করছি এ প্রসঙ্গে - “A poet's work is to name the unnameable, to point at frauds, to take sides, start arguments, shape the world, and stop it going to sleep.” একই কথা আমারও।

sazzadqadir@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন