বৃহস্পতিবার, ২১ জুন, ২০১২

ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র

বিশ্ব শরণার্থী দিবস ২০শে জুন। পরের দিন ২১শে জুন  বিশ্ব মানবতা দিবস। বিশ্ব শরণার্থী দিবসের এ বছরের বিষয়বস্তু: “Refugees have no choice. You do.”   এই থিম বা স্লোগানে শরণার্থীরা কত অসহায় আর আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কত বেশি - সেটাই বলা হয়েছে বিশেষ করে। পর-পর এমন দু’টি দিনে রোহিঙ্গাদের কথাই মনে পড়েছে বেশি। ওরা আমাদের প্রতিবেশী। সে হিসেবে ওদের প্রতি নানা কর্তব্য আছে আমাদের। এ দেশেরই প্রবাদ - ঘরের কাছে ঘর, আমি কি তোমার পর? ধর্মেও নির্দেশ আছে প্রতিবেশীদের প্রতি করণীয় সম্পর্কে। মহানবী (স) বলেছেন, প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে নিজে অন্ন গ্রহণ করবে না। নিজের জন্য যা ভাল মনে করবে, প্রতিবেশীর জন্যও তা ভাল মনে করবে। নিজেকে নিরাপদ রাখবে প্রতিবেশীদের জন্য। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি তিন-তিন বার উচ্চারণ করেছেন - যার আচরণ তার প্রতিবেশীর জন্য নিরাপদ নয় সে মুসলমান নয় ("He is not a believer whose neighbor is unsafe from his mischief." )। এক নারী সারা রাত নামাজ-জিকির করেন, দিনে রোজা রাখেন, অনেক দান-খয়রাত করেন, কিন্তু প্রতিবেশীদের সঙ্গে মুখ নাড়েন খুব? তার কি হবে? মহানবী (স) বলেন, সে যাবে জাহান্নামে।  আরেক নারী ধর্মকর্ম পালন করেন কেবল যেটুকু না করলেই নয়, কিন্তু প্রতিবেশীরা গুণগান করেন তাঁর। কি হবে ওই নারীর? মহানবী (স) বলেন, তিনি হবেন বেহেশতবাসী। প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “... help him if he asks your help,  to lend him if he asks to borrow from you, to satisfy his needs  if he becomes poor, to console him if he is visited by an affliction, ... to visit him if he becomes ill,...”। ঈসা (আ.) বলেছেন, নিজেকে যেমন ভালবাসো - প্রতিবেশীকেও তেমন ভালবাসবে। মুসা (আ.)-কে প্রদত্ত ১০ ঐশী বাণীর দশমটিতে বলা হয়েছে - প্রতিবেশীর স্ত্রী, ভৃত্য, পরিচারিকা, ষাঁড়, গাধা, কোনও কিছুর দিকে নজর দেবে না।
    এমন সুবচন অনেক আছে প্রতিবেশী সম্পর্কে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৪-১৮৯৯) লিখেছেন, “... বঙ্গবাসীমাত্রই সজ্জন; বঙ্গে কেবল প্রতিবাসীরাই দুরাত্মা। যাহা নিন্দা শুনা যায় তাহা কেবল প্রতিবাসীর। প্রতিবাসীরা পরশ্রীকাতর, দাম্ভিক, কলহপ্রিয়, লোভী, কৃপণ, বঞ্চক। ... যাহাদের প্রতিবাসী নাই, তাহাদের ক্রোধ নাই।...” (‘পালামৌ’, ১৮৮০-৮২)।
খুঁজলে দেখবো সকল দেশের সংবিধানেও আছে সৎপ্রতিবেশীমূলক সম্পর্কের অঙ্গীকার, কিন্তু কোনও দেশের সঙ্গেই ভাল সম্পর্ক নেই তার প্রতিবেশীর। আমাদেরও অনেক সমস্যা অন্যতম প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে। বিএসএফ, বাঁধ, ব্যবসা-বাণিজ্য, পানি, ভিসা, যাতায়াত প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যা দূরীকরণে অগ্রগতি নেই আশানুরূপ। দুই দেশের এক শ্রেণীর আমলা, ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারিদের এজন্য দায়ী করেন অনেকে। সেই তুলনায় আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি ছাড়া আর কোনও সমস্যা নেই বললেই চলে। এ পরিস্থিতি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের। জন্মগত ও অন্যান্য সূত্রে অধিকার থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে রাজি নয় মিয়ানমার। তাদের পরিচয় দিতে গিয়ে জাতিসংঘ বলেছে, মিয়ানমারে বসবাসকারী মুসলমানরা রাষ্ট্রহীন। তারা বিশ্বের সবচেয়ে নিগৃহীত ও অবহেলিত জনগোষ্ঠী। মিয়ানমারের বৌদ্ধদের ঘৃণা, বিদ্বেষ, নিপীড়ন, নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গারা প্রায়ই দেশ ছেড়ে আশ্রয় খোঁজে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া ও অন্যান্য দেশে। কিন্তু সে আশ্রয় দিতে রাজি নয় তাদের। হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের শিকার হয়ে সেই সত্তর ও নব্বই দশকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে অনেক রোহিঙ্গা। তাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহারই করেছি আমরা। পুরুষদের সস্তা শ্রম নিয়েছি, অপরাধ জগতে ঢুকিয়েছি, রাজনীতির চ্যালাকাঠ বানিয়েছি, আর নারীদের করেছি লালসার শিকার। আর এখন, আবার যখন প্রাণ বাঁচাতে ওই বিপন্ন অসহায় নরনারীশিশুরা আসছে আমাদের দ্বারে, তখন দূর-দূর করে তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছি আমরা। বিভিন্ন দেশে আমাদের অনেকের সঙ্গে যে রকম অমানবিক আচরণ করা হয়, ঠিক সে রকম আচরণই আমরা করছি তাদের প্রতি। শুধু তাই নয়, যে অশ্রাব্য ভাষায় একটি জনগোষ্ঠীকে আমরা কলঙ্কিত ও অপরাধী প্রমাণের চেষ্টা করছি তাতে মনে হয় না, আমাদেরই এক কবি একদিন গেয়েছেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। মনে হয় বঙ্গোপসাগরে ভাসমান মানবতার দিকে তাকিয়েই নজরুল লিখেছিলেন : “... অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ, / কা-ারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃ-মুক্তি পণ! ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? / কা-ারী! বলো, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!...” ভাবি, ৬২২ অব্দের সেপটেম্বর-অকটোবরে মককা থেকে মদিনায় যাওয়া মানুষগুলোর কথা, একাত্তরের মার্চ-নভেম্বরে আমাদের ভারতে যাওয়ার কথা। এভাবে যুগে-যুগে মানুষ শরণার্থী হয়েছে, কিন্তু এমন নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যানের দৃষ্টান্ত আছে কি কোথাও? মানবতাবাদী, শান্তিবাদী, আতিথ্যপরায়ন হিসেবে বাঙালির বিশ্বখ্যাতি আজ মুখ ঢাকছে লজ্জায়।
    কিন্তু না, এ লজ্জা আমরা বইবো না। বিশ্বসমাজের সঙ্গে সমস্বরে সাড়া দিতে হবে আমাদের। রোহিঙ্গা সমস্যার দিকে জোর পদক্ষেপ নিয়েছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মারকিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠী। ফলে মিয়ানমার-এর বর্তমান সংস্কারপন্থি সরকার এবং রাজনৈতিক স্বার্থে নিশ্চুপ অং সান সু চি-কে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের প্রাপ্য অধিকার দিতে হবে, তাদের প্রতি নিগ্রহ-নির্যাতনের অবসান ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী হিসেবে যথোচিত ভূমিকা নিতে হবে বাংলাদেশকে। আর প্রতিবেশী হিসেবে সে ভূমিকা কেমন হতে পারে তার একটু নমুনা তুলে ধরছি এখানে - যাঁরা নিজেদের ভারতপন্থি বলে গর্ব করেন কিন্তু ভারতের কাছ থেকে ভাল কিছু শেখেন না - তাঁদের জন্য। নমুনাটি উদ্ধৃত করছি পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত বাচিক শিল্পী, আকাশবাণী-দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব, জগন্নাথ বসু’র স্মৃতিকথা “বেতারের কথকতা এবং” (কলকাতা, ২০১০) থেকে:
    “... হত্যালীলা চলছে তখন সদ্যভূমিষ্ঠ বাংলাদেশে। ব্যাপারটা যখন চরমে উঠেছে, সে সময় স্টুডিওতে নেমে এলেন থমথমে মুখে অধিকর্তা দিলীপকুমার সেনগুপ্ত। আদেশের সুরে বললেন, ‘জগন্নাথ, টক স্টুডিওতে এসো।’ যেতেই একটা পাতা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এখনই এটি তোমাকে পড়তে হবে।’ তাতে লেখা, ‘প্রতিবেশী বাংলাদেশে যে অরাজকতা ও জনবিরোধী কার্যকলাপ ঘটে চলেছে, ভারত তার প্রতিটি ঘটনাপ্রবাহের প্রতি লক্ষ্য রাখছে। ভারত আরও জানাচ্ছে, এই সব মৌলবাদী অশুভ শক্তি যদি এখনও সংযত না হয়, তা হলে ভারত কিন্তু আর হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না।’ আমি মাইকের সামনে কাগজটি নিয়ে যেতেই উনি আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘দেখো আবার পেলব কণ্ঠে পরিশীলিত উচ্চারণে যেন কথাগুলি বলো না। তোমার ভঙ্গিতে যেন হুমকিটা স্পষ্ট থাকে। কি, পারবে তো গলায় ঝাঁঝ দিয়ে বলতে?’...”

facebook.com/sazpa85

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন