শনিবার, ১৬ জুন, ২০১২

অবিশ্বাস নামের গৃহশত্রু

কোনও মানুষই দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নন, কাজেই কেউ সমালোচনারও ঊর্ধ্বে নন, তারপরও কোনও-কোনও মানুষ আছেন দোষ বা ত্রুটি কখনও প্রশ্ন বা প্রসঙ্গ হয়ে ওঠে না তাদের ক্ষেত্রে। তারা অলোকসাধারণ অসামান্য ব্যক্তিত্ব। তাদের দেখার সুযোগ মেলে না সহজে, কিন্তু আমার নিজের শতেক দোষ-ত্রুটি থাকলেও শুধু দেখা নয়, সান্নিধ্যও পেয়েছি এমন কয়েকজন ক্ষণজন্মা মহানুভবের। তাদের একজন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। সেই ১৯৬৬ সাল থেকে সঙ্গে আছি তার। কাজেকর্মে থাকি, কাজকর্ম না থাকলে মনে-মনেও থাকি। অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, তবে বিনয়ের সঙ্গেই বলি - এক ধরনের নিবেদন ও সততায় শুদ্ধতা নিয়ে বড় হয়েছি গত শতকের পঞ্চাশ-ষাট দশকের অস্থির সময়ে। এই শুদ্ধ জীবনের প্রেরণা শুধু পারিবারিক সূত্র থেকে ছিল না, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ঘোর আচ্ছন্নতা থেকেও ছিল দায়বদ্ধতা। অগ্রজ তারাপদ রায়, জওশন খান, রফিক আজাদ, বুলবুল খান মাহবুব, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা এবং আরও অনেকে সততায় সুস্থতায় শুদ্ধতায় প্রাণিত করেছেন নানা ভাবে নানা সময়ে। কিন্তু এই যে আমার সৎ ও নিবেদিত থাকার সাধনায় পূর্ণতা সন্ধান - এর মূলে সবচেয়ে বেশি অবদান যার তিনি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তাকে দেখে শিখেছি জীবনচর্চা, তার কাছে জেনেছি শিল্পসুলুক, বুঝেছি সমাজবীক্ষার মর্ম ও মাহাত্ম্য, তারপর প্রতিষ্ঠাবিরোধী হয়েও থেকেছি শ্রদ্ধাবান, ভালবেসেছি যাবতীয় নতুনকে, সমর্থন যুগিয়েছি সকল সম্ভাবনাকে। এই যে অসতের সঙ্গে আপস করি না, অবৈধ অর্থ-সম্পদের দিকে হাত বাড়াই না, সুযোগ সত্ত্বেও চরিত্র রক্ষা করি, অতি অল্প লইয়া থাকি, দুঃখ-দারিদ্র্য কষ্ট-গঞ্জনা সই - আমার এই যে এত ব্যর্থতা - এ সবের জন্য মূলত তাকেই দায়ী করি আমি। কারণ আমার সামনে অত বেশি আদর্শ ছিল না, নেই-ও, এ অবস্থায় সততায় নিবেদিত শুদ্ধ কর্মিষ্ঠ জীবনের এক মহান প্রতীক হয়ে আছেন তিনি। কিন্তু যে সময়ে সমাজে এসে পৌঁছেছি আমরা - তাতে এ সবই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে তার সবচেয়ে বড় দোষ ও ত্রুটি!
    জাতীয় সংসদে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সমালোচনা, তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ শুনে ভীষণ রাগ হয়েছিল আমার। বিশেষভাবে তার ব্যক্তিচরিত্র নিয়ে কটাক্ষ করায় বেশিই হয়েছিল রাগটা। এক পর্যায়ে চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসার মতো একটা অবস্থাও হয়েছিল তখন। ওই অবস্থাতেই লিখে ফেলেছিলাম ‘ঠাকুরঘরে কে রে?’ নামে এক লেখা। পরে সংবরণ করি রাগ। ভাবি, সায়ীদ ভাই তো আক্রান্ত নন এই প্রথম? সেই স্বাক্ষর-কণ্ঠস্বর যুগে, ষাট দশকের প্রথম দিকে, ‘পুবালী’র ‘ঢাকায় থাকি’ কলামে ‘নাগরিক’ তাকে গালমন্দ করেছিলেন ‘পালের গোদা’ বলে। তারপর যাদের তিনি ‘কণ্ঠস্বর’-এ তুলে ধরেছেন, লিখেছেন যাদের নিয়ে, সুযোগ করে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠার, তারা-ও তো আড়ালে-আবডালে কম নিন্দা করে নি তার। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সম্পর্কেও অনেক অদ্ভুত খবর বেরিয়েছে পত্রপত্রিকায়। কিন্তু সহ্য করেই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ জয় করেছেন সব কিছু। ওই ‘নাগরিক’কেও। এবার দেখলাম তিনি বিবৃতি দিয়েছেন তার পক্ষ নিয়ে।
    চারপাশে এত ধান্দাবাজ, মিথ্যাবাদী ও বেয়াদব যে সমাজের সুস্থতা সম্পর্কে বিশ্বাস রাখা এখন কঠিন। কিন্তু আশ্চর্য নীতি ও আদর্শের জোর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের। বিশ্বাস তিনি হারান না কখনওই। কোথায় পান এত শক্তি? এত ইতিবাচক প্রাণশক্তি? আমার তো সহ্যই হয় না ধান্দাবাজ, মিথ্যুক আর বেয়াদবদের, কিন্তু দেখেছি তার সহিষ্ণুতা কত বেশি! যে কাউকে আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়ার মতো উদার বিশালতা তার প্রায় অনন্ত অসীম। আর তা কত স্বাভাবিক যে এ নিয়ে কোনও রাগ হয় না তার ওপর, বিন্দুমাত্র সমালোচনার চিন্তাও ঢোকে না মাথায়।
    ভাবি, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পর্কে যারা কটূক্তি করেছেন তারা কি করে ধারণা করতে পারলেন ওই মানুষটি কোনও দুষ্কর্ম করতে পারেন? কখনও কি নিন্দনীয় কিছু শুনেছেন জেনেছেন তাঁর সম্পর্কে? আসলে আমরা বোধহয় বাস করি এমন এক সমাজে যেখানে বিশ্বাস নিহত হয়েছে অনেক আগেই। তাই কেউ সমর্পিত আছেন সততায় তা কারও ধারণাতেই যেন আসে না। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি। আমার মতো একজন নিঃস্ব ক্লিষ্ট মানুষকেও শুনতে হয়েছে বিপুল অর্থবিত্তের অপবাদ, সেখানে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের গাড়ি-বাড়ি নিয়ে প্রশ্ন ওঠা কি অসম্ভব? সমাজ কি এ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কাউকে বিশ্বাস করার যো নেই? তবে কি অবিশ্বাস নামের গৃহশত্রুকে নিয়েই বাস করে যেতে হবে আমাদের?
facebook.com/sazpa85

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন