মঙ্গলবার, ৩ জুলাই, ২০১২

সত্যের তাঁবেদার থেকে তাঁবেদারের সত্য

দৈনিক আজাদ-এ সংবাদ শিরোনামে দীর্ঘ ঈ-কারের মাথাটা ভাঙা-ই থাকতো। পড়ে বুঝে নিতে হতো ‘সুখা’ না ‘সুখী’। তাই “ড. শহীদুল্লাহ মারী গিয়াছেন” শিরোনামটিকে “ড. শহীদুল্লাহ মারা গিয়াছেন” দেখাতে কোনও সমস্যায় পড়ে নি আমাদের ক্লাশ ক্যাপটেন খোকা (চিত্রনায়ক মান্না’র চাচা)। শিক্ষকরাও ওটুকু দেখেই ছুটি ঘোষণা করেন স্কুলের। মূল খবরটি পড়ার দরকার মনে করেন নি আর। এ ঘটনা ১৯৫৫ সালের, তখন পড়ি টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী স্কুলে ক্লাশ ফোর-এ।
    সংবাদপত্রের এমন বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল তখন। কথাই ছিল ‘ছাপা জিনিসে ভুল নাই’। পরে অবশ্য ছাপাখানার ভূতের কবলে পড়েছি বহুবার। ভুল পড়েছি, করেছিও। এখন তো থাকি ভূতের ছাপাখানাতেই। ভুল-নির্ভুল সবই ধোঁয়া-ধোঁয়া ছায়া-ছায়া। কোনটা কি তা কিছুই বলতে পারেন না কেউ। বোঝাও যায় না। সংবাদপত্রে পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে সংবাদ ও বিজ্ঞাপন। জায়গা নেয়ার পর জায়গা-বদল হয়েছে কিনা তা বলতে পারেন না কেউ।
    এ বছর সংবাদপত্রের কাজে ও সাংবাদিকতায় ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে আমার। সেই অভিজ্ঞতা ও অবিশ্বাসের কথা ও কাহিনী কিছু বলি এখানে।
    ছোটবেলা থেকেই অনেক কিছু আমি ভুল শিখেছি সংবাদপত্রের কারণে। বানান, অর্থ,... আরও অনেক কিছু। এ সব শুদ্ধ ও সিদ্ধ করে নিতে বহু সময় লেগেছে আমার। কিছু উদাহরণ দিতে পারি এখানে।
পঙ্‌ক্তি, আকাঙক্ষা, সমীচীন, ঊর্ধ্ব, উজ্জ্বল, কর্মজীবী, মোহ্যমান, অগস্ট, ঘুস, সর্বজনীন - এ বানানগুলোর অশুদ্ধ রূপ হরহামেশা ছাপা হয় সংবাদপত্রে। ভুল অর্থে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ক্রন্দসী, ফলশ্রুতি, আপামর ও আরও অনেক শব্দ। ‘পরে’ অর্থে ‘পরবর্তীতে’ লেখা, ‘ডিপার্টমেন্ট স্টোর’কে ‘ডিপার্টমেন্টাল স্টোর’ লেখা সংবাদপত্রেরই দান। আরও অবদান - কৃচ্ছ্রতা, প্রয়োজনীয়তা, রহস্যময়তা, জবাবদিহিতা, অনবধানতা, সিংহভাগ, পাশবিক, উল্লেখিত, অশ্রুসজল, সুস্বাগতম প্রভৃতি ভুল শব্দ; অসুস্থতাজনিত কারণে, চলাকালীন সময়ে, জোরপূর্বক ধর্ষণ, সারা দেশ জুড়ে, হাজার জনতা, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু, অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, গুরুত্বারোপ, স্থগিতের সিদ্ধান্ত, নিষিদ্ধের দাবি প্রভৃতি ভুল শব্দবন্ধ।  কোথায় ‘ও’ আর কোথায় ‘ও-কার’ তা গুলিয়ে দিয়েছে সংবাদপত্র। আই ‘আজও’ না লিখে ‘আজো’ লিখি, কিন্তু ‘কালো’ না লিখে লিখি ‘কালও’। দপ্তর, গ্রেপ্তার, করপোরেশন, পন্থি, সরজমিন প্রভৃতি শব্দের এবং ক্রিয়াপদের বানানভেদ এখন বহুপ্রচলিত। বানানভেদের শিকার কাওরানবাজার, ফকিরাপুল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মুন্সীগঞ্জ, ঝালকাঠী, রাঙ্গামাটি, টাঙ্গাইল সহ অনেক স্থান-নাম। মিয়ানমার, ইয়াঙ্গন, প্যারিস, পেইচিং, কেরল, অসম, ওড়িশা, মুম্বই, চেন্নই, নিউ ইয়র্ক, লস অ্যানজেলেস, জোহানেসবার্গ, কুয়ালা লুমপুর প্রভৃতি বিদেশী স্থান-নাম; এসিড, একাউন্ট, এডভোকেট, এলবাম প্রভৃতি বিদেশী শব্দের বানান নিয়ে চলছে যথেচ্ছাচার।
এ তো গেল সংবাদ লেখার ভাষা আমার নিজের ভাষা মাতৃভাষার অবস্থা। বলা হবে, এ সমস্যা অজ্ঞতার। এ অজ্ঞতা থেকে ওসামাকে লেখা হয় লাদেন - যা আসলে তার পিতার নাম। এভাবে ইখতিয়ার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বখতিয়ার নামে। এ সমস্যা অজ্ঞতার নয়, এ কৌশল অজ্ঞতা সৃষ্টির। এভাবেই ভাষাদৌর্বল্যের সুবাদে গোড়াতেই তৈরি হয়ে যায় মিডিয়ার একটা দুর্বল নড়বড়ে ভিত। আর দুর্বলকে তো সহজেই গড়ে তোলা যায় প্রবলের ইচ্ছামতো, তাকে নেয়া যায় নিজের নিয়ন্ত্রণে, রাখা যায় ইচ্ছাধীন। আর সংবাদ - যুদ্ধে ও রাজনীতিতে সত্য যেখানে নিহত হয় প্রথমে সেখানে সে সত্যবাদ মেনে চলে কতখানি? আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলি।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের গর্ব ও গৌরবের অন্ত নেই, আমাদের মিডিয়াও এ আবেগে উচ্ছ্বসিত। এ হিসেবে পৃথিবীর সকল মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমাদের কেবল সমর্থন নয়, অঙ্গীকারও আছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা বড্ড কুণ্ঠিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের  মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা বর্ণনা করি তাদের প্রতিপক্ষের ভাষায়। লিখি, বিচ্ছিন্নতাবাদী। সন্ত্রাসী, জঙ্গি, উগ্রপন্থি, চরমপন্থি, নাশকতাবাদী। হঠাৎ কেউ লেখেন, স্বাধীনতাকামী। এছাড়া বামপন্থি, দক্ষিণপন্থি ইত্যাদি লেবেল আঁটা তো আছেই। জানতে ইচ্ছা করে, ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে নির্ণয় করা হলো আমাদের দশ দিক? একই ভাবে ব্যাখ্যা মেলে না উদারপন্থি, মধ্যপন্থি ইত্যাদি টুপি পরানোরও। মনে আছে, বাবরি মসজিদকে অনেকে উল্লেখ করেছেন ‘বিতর্কিত কাঠামো’ হিসেবে। এটা করা হয়েছিল প্রেস ট্রাস্ট অভ ইনডিয়া (পিটিআই)-এর রিপোর্ট হুবহু অনুবাদ করার কারণে। ১৯৮২ সালের সেপটেম্বর-অকটোবরে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার আন্দোলন চলাকালে বাবরি মসজিদকে ‘ডিসপুটেড স্ট্রাকচার’ বলে উল্লেখ করতো ওই সরকারি ভারতীয় বার্তা সংস্থা। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে শরীরে বোমা বহন করে বিস্ফোরণ ঘটাতো লক্ষ্যস্থলে গিয়ে। তাদের শত্রুপক্ষের ভাষায় আমরা ওই যোদ্ধার পরিচয় লিখেছি ‘আত্মঘাতী’ বা ‘মানববোমা’। কিন্তু আত্মঘাত সমর্থন করে না ইসলাম। ওই মুক্তিযোদ্ধারাও একে আত্মঘাত বলেন না। নিজেদের পরিচয় তাঁরা দেন ‘প্রতিরোধ যোদ্ধা’ হিসেবে।  মধ্যপ্রাচ্যের মিডিয়া-ও ব্যবহার করে এ শব্দটি। কিন্তু আমরা করি না কোন অজ্ঞাত কারণে। প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতে এমন ভাষা-চাতুর্য সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে ওই ভাষাদৌর্বল্যের কারণে।
ঘটনা আড়াল করার ঘটনাও তৈরি করা হয় অনেক। সাম্প্রতিক উদাহরণ রোহিঙ্গা পরিস্থিতি। তাদের শরণার্থী অবস্থাটাই বেশি-বেশি করে তুলে ধরেছে মিডিয়া, কিন্তু তারা যে নৃশংস নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের শিকার - সে ব্যাপারে বিস্ময়কররূপে নিশ্চুপ। আরেক জ্বলন্ত উদাহরণ, আমাদের সীমান্তে বিএসএফ-এর বর্বরতার খবর। অনেক খবরে হতাহতদের চোরাচালানি বা দুর্বৃত্ত হিসেবে তুলে ধরে সাফাই গাওয়া হয় বিশেষ উদ্দেশ্যে। এভাবে যে কাউকে হত্যা বা নির্যাতন করা যায় না - এই সত্যটিকেই অস্বীকার করা হয় এভাবে।
প্রতি দিন এ রকম নানা ভাবে ঘটনা, বিষয় ও ভাষাকে বিকৃত করে মিডিয়ায় হত্যা করা হয় সত্যকে। এ দেশে রাজনীতিকরা ইতিহাসচর্চা করেন, ইতিহাসবিদরা প্রকল্প বানিয়ে ধান্দা করেন, ধান্দাবাজরা শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যবসা করেন, আর ব্যবসায়ীরা করেন রাজনীতি - কাজেই সত্যের তাঁবেদার মিডিয়া সহজেই পরিণত হয় তাঁবেদারের সত্যে। এজন্য এ দেশে মুক্তিযুদ্ধ, মুজিব-জিয়া হত্যা থেকে জনঅভ্যুত্থান পর্যন্ত অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটলেও মিডিয়া ব্যর্থ হয়েছে অনুসন্ধানে ও বিশ্লেষণে।
sazzadqadir@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন