বৃহস্পতিবার, ১৯ জুলাই, ২০১২

হতাশা, তবে অধিক নয়

আশা আর বাসা ছোট করতে নেই - শুনেছি ছোটবেলায়। কিন্তু জীবনে ছোট হয়ে এসেছে দু’টোই। অভিযোগ-অনুযোগ করছি না এ জন্য। কারণ, ভালই হয়েছে এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র থাকা। ঠেকে-ঠেকে শিখেছি  - অধিক প্রত্যাশা না থাকাই ভাল, কারণ তা অধিক হতাশাই ডেকে আনে। ইতিহাসও এ সত্যের সাক্ষী হয়েছে বারবার। পাকিস্তান আন্দোলনের উদ্ভব, বিকাশ ও তীব্রতা এই বাংলাভাষী পূর্ববঙ্গে, অথচ এখানে এসে তখনকার অবিসংবাদিত নেতা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ বললেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উরদু! তাঁর এ ঘোষণা যে হতাশা সৃষ্টি করে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে তার অনিবার্য পরিণতি রূপে দেখা দেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। অন্য নেতাদের কথাও বলি। মহাত্মা গান্ধী’র মতো একজন মহান নেতার উদ্ভট যৌন পরীক্ষা সম্পর্কে জেনে যে পর্যায়ে বিস্ময়হত হয়েছি তা এক ধরনের হতাশাই বৈ কি! ভারত-বিভাগে জওয়াহরলাল নেহরু’র ভূমিকা নিশ্চয়ই ব্যথিত করেছে অনেককে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে, স্বাধীনতা অর্জনে যাঁর অবদান অবিস্মরণীয় - সেই ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে কি হতাশা আছে কোনও? আছে। বাংলাদেশকে ছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে সিমলা চুক্তি নিশ্চয়ই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে অনেককে। ’৭৫-এ তাঁর জরুরি অবস্থা ঘোষণাও ভাল লাগে নি আমার। এবার দেশের কথা বলি মন খুলে - কারও খারাপ লাগলে লাগুক। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ শত্রুমুক্ত হয়, তারপর গ্রাম থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের ফেরত পাঠিয়ে স্বাধীন দেশের প্রশাসন তুলে দিতে হয় পরাজিত পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রশাসনের হাতে। একে এখানে, ওকে ওখানে বদলি করে অবস্থা দাঁড়ায় সেই থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়! বলতে গেলে এক অর্থে শত্রুপক্ষের হাতেই যায় বিজয়ের ফল। ক’দিন আগে যাদের দেখে গুলি করতো মুক্তিযোদ্ধারা সেই তাদের কাছেই সমর্পণ করতে হয় অস্ত্র। বিষয়টি বেশ হতাশ করে আমাকে। ভেবেছিলাম জাতীয় সরকার গঠিত হবে, দেশ হবে সর্বাধুনিক কল্যাণরাষ্ট্র, বঙ্গবন্ধু স্থান পাবেন সবার ঊর্ধ্বে - হবেন দেশ জাতি জনগণের অভিভাবক, নিজেকে জড়াবেন না ক্ষমতার রাজনীতিতে। কিন্তু হয় নি সে সব কিছু। এসেছে সর্বহারা পার্টি, গণবাহিনী, রক্ষীবাহিনী, চুয়াত্তর। বাকশাল সম্পর্কে মন্তব্য করা ঠিক হবে না, কারণ কার্যকর বা বাস্তবায়িত হয় নি তা। এটুকু বলতে পারি, বাকশাল বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাঁদের ওপর দেয়া হয়েছিল তাঁদের সবাই যে যোগ্য ছিলেন না তা প্রমাণিত হয়েছে কিছু পরেই।
    ’৭৫-এর পরের সরকারগুলো সম্পর্কে কোনও প্রত্যাশা ছিল না, তাই তাদের নিয়ে কোনও হতাশাবোধ নেই আমার। স্বৈরতন্ত্র ও চৌর্যতন্ত্রের উল্লাস-নৃত্য আর গণতন্ত্রের ফিয়াসকো দেখে-দেখে একটু ক্লান্ত - এই যা। তবে সম্প্রতি আমাকে বিশেষভাবে হতাশ করেছেন ‘গণতন্ত্রের দেবী’ আখ্যাত নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী মিয়ানমারের ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি পার্টির নেত্রী ড অন সান সু চি। এছাড়া পেয়েছেন বাকস্বাধীনতার সাখারভ প্রাইজ, মানবাধিকারের ভাসলাভ হাভেল প্রাইজ, নেলসন মানদেলা সংগঠিত এলডারস্‌-এরও সদস্য তিনি। কিন্তু সম্প্রতি রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা সম্প্রদায় যখন হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের শিকার হয় তখন একটি কথাও বলেন নি ড সু। পৃথিবীর সবচেয়ে নিগৃহীত এ সম্প্রদায় সম্পর্কে শান্তি, স্বাধীনতা ও অধিকারের পুরস্কার-সম্মাননায় ভূষিত এই মহান নেত্রী বিস্ময়করভাবে নীরব। শুনেছি মিয়ানমারে তাঁর সমালোচকের সংখ্যাও কম নয়। তাঁরা ‘পশ্চিমাদের ট্রয়ের ঘোড়া’ মনে করেন তাঁকে। এ কারণে তাঁর ব্যাপারে আমি হতাশ হলেও তা অধিক নয়। তাহলেও “আশা হৃদয়ের চেয়ে বড়, তাই তারে / হৃদয়ের ব্যথা বলে মনে হয়।” (রবীন্দ্রনাথ)
sazzadqadir@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন