বৃহস্পতিবার, ১২ জুলাই, ২০১২

‘মুই কি হনু রে...’

আমাদের এই ঢাকার কবি-সাংবাদিক হরিশচন্দ্র মিত্র (আ. ১৮৩৮-১৮৭২)-এর কয়েকটি নীতিকবিতা ছোটবেলায় পড়েছি পাঠ্যপুস্তকে, মুখস্থ করেছি, আবার ভাবসম্প্রসারণও লিখেছি পরীক্ষার খাতায়। ‘খেলায় মজিয়া শিশু কাটাও না বেলা / সময়ের প্রতি কভু করিও না হেলা...’ কবিতাটির (‘সময়’, “কবিতা কৌমুদী”, ১৮৬৩) কথা হয়তো মনে আছে অনেকের, তবে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা সম্ভবত ‘বড় কে?’ (প্রাগুক্ত)। কারণ এখনও তা ফেরে লোকের মুখে-মুখে - “আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয় / লোকে যারে বড় বলে, বড় সেই হয়।...” এ কবিতা আমি পড়েছি, আমার সঙ্গে পড়েছে আরও অনেকে। কিন্তু নম্র নত বিনীত হয়ে থাকার ধাত বোধহয় অনেকের থাকেই না। তাই দেখেছি সহপাঠীদের কেউ-কেউ ত্রুটি ধরতো শিক্ষকদের, গুরুজনদের। সাফল্যও যে বিগড়ে দেয় অনেককে তা-ও দেখেছি। তাদের দু’একজন ভুল খুঁজে বেড়াতো যাদবচন্দ্র চক্রবর্তী (১৮৫৫-১৯২৩)-র ‘পাটীগণিত’, কে পি বসু’র ‘জ্যামিতি’ ও ‘বীজগণিত’-এ। ফুটবলে কিছু কসরত শিখেই কেউ-কেউ প্রকাশ্যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো মারী গাজি ওমর শোভা নবী চৌধুরীকে। কয়েকটি নাটকে হাততালি পাওয়ার পর যারা নিজেকে উত্তম কুমারের চেয়ে বড় অভিনেতা বা বিধায়ক ভট্টাচার্যের চেয়ে বড় নাট্যকার ভেবেছিল তাদের সম্পর্কে তখনই এক মুরব্বি বলেছিলেন, ‘এ দেশের প্রতিভা গোখরো সাপের মতো আসে, আর ঢোঁড়া সাপ হয়ে মরে যায়!”
    পণ্ডিতেরা বলেন, নিজেকে অতি বড় ভাবা একটা বাতিক। অহঙ্কার, দম্ভ, আত্মম্ভরিতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ এই অতিআত্মমন্যতা। চিকিৎসাশাস্ত্রে এর নাম ‘মেগালোম্যানিয়া’, এটা এক ধরনের মানসিক ব্যাধি, মনোবৈকল্য...“a delusional mental disorder that is marked by feelings of personal omnipotence and grandeur.” সাহিত্য ও সাংবাদিকতার জগতে আছি ৫০ বছর ধরে। এ মনঃবিকলন কম দেখা হলো না এ পর্যন্ত। আর্ট বুকওয়াল্ড (১৯২৫-২০০৭)-কে শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে পারেন এমন কলামনিস্ট আছেন এখানে। সাংবাদিক আছেন - যাঁদের কাছে কার্ল বার্নস্টাইন, বব উডওয়ার্ড, রবার্ট ফিস্ক, ওরিয়ানা ফালাচি (১৯২৯-২০০৬), ক্রিসটিয়ান আমানপুর একেবারেই নস্যি। কবিদের মধ্যে অন্তত পাঁচজনকে জানি যাঁরা নিজেদের ভাবেন রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় কবি। এঁদের দু’জনকে আলাদা-আলাদা ভাবে বলেছিলাম, আপনার আরবি নামটা সংস্কৃতে অনুবাদ করলে কিন্তু ‘রবীন্দ্রনাথ’ হয়। শুনে খুশি হয়েই হেসেছেন দু’জনে। এ সব অতিআত্মম্মন্যতা নিজেদের ছাড়া আর কারও ক্ষতি করে না, কিন্তু রাজনীতিক-দেশনায়করা যদি মেগালোম্যানিয়াক হয়ে পড়েন তখন কেবল নিজের নয় দেশের মানুষের জীবনেও ডেকে আনেন সর্বনাশ। ইতিহাসে তাঁদের অনেকে কুখ্যাত হয়ে আছেন নানা উদ্ভট চিন্তা ও কা-কীর্তির জন্য। মহাবীর আলেকজান্ডার (৩৫৬-৩২৩ পূর্বাব্দ) শেষ জীবনে নিজেকে ভাবতেন গ্রিক দেবতা জিউস ও মিশরীয় দেবতা আমোন-এর সন্তান। আমোন-এর মতো করে নিজের কল্পিত শিংওয়ালা মাথা তিনি খোদিত করেছিলেন মুদ্রায়। ইতালি’র একনায়ক মুসোলিনি (১৮৮৩-১৯৪৫) বলতেন রোমান সাম্রাজ্যের গৌরব প্রতিষ্ঠার কথা। তাঁর বিশাল প্রশাসনিক ভবনের উপরে তিনি স্থাপন করেছিলেন নিজের অতিকায় মুখাকৃতি। উগান্ডা’র একনায়ক ইদি আমিন দাদা (শাসনকাল ১৯৭১-১৯৭৯) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ছিলেন বৃটিশ বাহিনীর সারজেন্ট। ওই যুদ্ধে সাহসিকতার সর্বোচ্চ পদক ‘ভিকটোরিয়া ক্রস’ তিনি নিজেই দিয়েছিলেন নিজেকে। আরজেনটিনা’র জনপ্রিয় ফার্স্ট লেডি ইভা পেরন (১৯১৯-১৯৫২) ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট হওয়ার আশায় ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন নির্বাচনে। শোচনীয় ভরাডুবি হয়েছিল তাঁর। ফিলিপাইনের ফার্স্ট লেডি ইমেলদা মারকোস-এর জুতা ছিল প্রায় তিন হাজার জোড়া। উৎখাত হয়ে হাওয়াইয়ে স্বামীর সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিয়েছিলেন ২৪ বার সোনা। আর লুটেপুটে নেয়া বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার তো ছিলই। উত্তর কোরিয়া’র ‘মহান নেতা’ কিম ইল-সুং (১৯১২-১৯৯৪) দাবি করতেন - বালিকে ধান-চাল বানাতে পারেন, পাতায় চড়ে নদী পার হতে পারেন এবং আরও অনেক কিছু। দেশের বিভিন্ন স্থানে নিজের ৩০ হাজার মূর্তি স্থাপন করেছিলেন তিনি। এছাড়া দেশবাসীকে তিনি বাধ্য করেছিলেন তাঁর ছবি সংবলিত ব্যাজ পরতে। মিয়ানমারের স্বৈরশাসক নে উইন (শাসনকাল ১৯৬২-১৯৮২) গোসল করতেন ডলফিনের রক্তে। তাঁর দল বেশি বামপন্থি হয়ে পড়ছে আশঙ্কা করে দেশের সকল সড়কে ডান দিকে চলার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। কুসংস্কার আরও অনেক ছিল তাঁর। তিনি ব্রিজ পার হতেন পেছন দিকে চলে। ধারণা ছিল, ৯০ বছর বাঁচবেন তাই প্রচলন করেছিলেন ১৫, ৩০, ৪৫ ও ৯০ মানের নোট। এতে সঞ্চয় খুইয়ে বসেন মিয়ানমারের মানুষ। আলবেনিয়া’য় দাড়ি রাখা, টাইপরাইটার ও রঙিন টিভি নিষিদ্ধ করেছিলেন একনায়ক এনভার হোজা (আনোয়ার হোসেন, শাসনকাল ১৯৪১-১৯৮৫)। মন্ত্রীপরিষদের সকল পদ নিজের হাতে রেখেছিলেন তিনি। এছাড়া যুগোস্লাভিয়া’র আগ্রাসনের আশঙ্কায় দেশের বিভিন্ন স্থানে সাত লাখ ৫০ হাজার বাঙ্কার তৈরি তাঁর এক বিখ্যাত কীর্তি। আরও অনেক মেগালোম্যানিয়াক কলঙ্কিত করে আছেন বিশ্বের ইতিহাস। কিছু সাফল্য আর বিপুল হাততালি তাদের মধ্যে গড়ে তোলে ‘মুই কি হনু রে’ ভাব। এর পরিণাম শুভ হয় নি কখনও, হবেও না। হরিশচন্দ্র মিত্রের কবিতার বাকি অংশে ফিরে যাই: “বড় হওয়া সংসারেতে কঠিন ব্যাপার / সংসারে সে বড় হয়, বড় গুণ যার। / গুণেতে হইলে বড়, বড় বলে সবে / বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে।”


sazzadqadir@rediffmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন