সোমবার, ২ জুলাই, ২০১২

বর্ষার কাব্য পাঠ

বাংলার ছয় ঋতুর ছত্রিশ রূপ। সব রূপই প্রিয় আমাদের। তবু বসন্তকে বলেছি ঋতুরাজ, আর বর্ষাকে ঋতুরানী। বর্ষায় সজল সরসতায় ভূ-প্রকৃতি হয়ে ওঠে সতেজ সজীব। চারপাশে জেগে ওঠা এই প্রাণময়তা মুগ্ধ করে আমাদের, বিশেষভাবে উচ্ছ্বসিত করে কবিদের। শাস্ত্রবিদ জগদীশচন্দ্র ঘোষ লিখেছেন, “বর্ষা আমাদের হৃদয়ের, কালের ও কাব্যের সিংহাসন জুড়ে আছে।” এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের পক্ষপাতিত্ব তো প্রকাশ্যেই। অনেক কবিতা ও গান লিখেছেন তিনি বর্ষার বন্দনা করে। প্রবন্ধ-নিবন্ধও লিখেছেন অনেক। ‘আষাঢ়’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “বর্ষা ঋতুটা বিশেষভাবে কবির ঋতু।” আরও লিখেছেন, “ঋতুর মধ্যে বর্ষাই কেবল একা, একমাত্র। তাহার জুড়ি নাই।” এর কারণও ব্যাখ্যা করেছেন, “বর্ষাকে ক্ষত্রিয় বললে দোষ হয় না। তাহার নকিব আগে আগে গুরুগুরু শব্দে দামামা বাজাইতে বাজাইতে আসে, মেঘের পাগড়ি পরিয়া পশ্চাতে সে নিজে আসিয়া দেখা দেয়। অল্পে তাহার সন্তোষ নাই। দিগ্বিজয় করাই তাহার কাজ।” তবে এ কথাও স্বীকার করেছেন, “বর্ষা ঋতুটা মোটের উপরে শহুরে মনুষ্যসমাজের পক্ষে তেমন সুখকর নহে - ওটা আরণ্য প্রকৃতিরই বিশেষ উপযোগী।” বর্ষাকালীন শহরজীবন সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন একটি বাক্যে, “বর্ষা নামিয়াছে, ট্রামলাইনের মেরামতও শুরু।” শহরের এখানে-ওখানে খোঁড়াখুঁড়ি করে রাস্তা খানাখন্দে বীভৎস করে রাখার এ ঐতিহ্য এখনও অব্যাহত আছে সগৌরবে।
    বর্ষাকে অবশ্য ‘ঋতুপতি’ বলেছেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯)। এ ঋতুর বন্দনায়, রবীন্দ্রনাথের আগে, সম্ভবত তিনিই ছিলেন সব কবিকে ছাড়িয়ে। বর্ষায় প্রকৃতির রূপ এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে লিখেছেন অন্তত এক ডজন দীর্ঘ কবিতা - বর্ষার আবির্ভাব, বর্ষার অভিষেক, বর্ষার রাজ্যাভিষেক, বর্ষার ধুমধাম, বর্ষার অধিকারে গ্রীষ্মের প্রাদুর্ভাব, বর্ষা, বর্ষার বিক্রম বিস্তার, গ্রীষ্ম দমন পূর্ব্বক বর্ষার রাজ্য শাসন, বর্ষা-বর্ণন, বর্ষার ঝড়বৃষ্টি, বর্ষার অত্যাচার, সুবৃষ্টি। কবিতাগুলোর নাম উল্লেখ করলাম - যাতে বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেতে পারেন পাঠক। বর্ষায় সেকালের শহরবাসীর দুর্ভোগের বিবরণ মেলে এর অনেক কবিতাতেই:
    “... ঘর দ্বার পথ ঘাট মহা সিন্ধুময়।
    নীরাকারে নীরাকার দৃশ্য সব হয় ॥
    গৃহস্থের কান্নাহাটী রান্নাঘরে এসে।
    হাসিয়া ভাতের হাঁড়ি জলে যায় ভেসে ॥
    জোড়া পায় ঘোড়া নাচে চাকা ডুবে জলে।
    কলের জাহাজ যেন গাড়ী সব চলে ॥
    বালকে পুলক পায় ভাসাইয়া ভেলা।
    কিলি কিলি মীন যত পথে করে খেলা ॥
    পথিকের দশা দেখে নেত্রে জল ঝরে।
    উঠিছে পায়ের জুতা মাথার উপরে ॥
    বিশেষতঃ রমণীর ভাব চমৎকার।
    চলিতে চরণ বাধে বস্ত্র রাখা ভার ॥...” (‘বর্ষার বিক্রম বিস্তার’)
    দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩)-এর কবিতাতেও আছে শহুরে বর্ষার ছবি - ঘরোয়া পরিবেশের, পারিবারিক জীবনের বর্ণনা, কর্মহীন সময়ের অস্বস্তি:
    “বৃষ্টি পড়িতেছে টুপ্‌ টাপ্‌;
    বাতাসে পাতা ঝরে ঝুপ্‌ ঝাপ্‌;
    প্রবল ঝড় বহে - আম্র কাঁটাল সব -
    পড়িছে চারি দিকে ধুপ্‌ ধাপ্‌।
    বজ্র কড়কড় হাঁকে;
    গিন্নী শুয়ে বৌমাকে
    ‘কাপড় তোল্‌ বড়ি তোল্‌’ ঘন হাঁকে;
    অমনি ছাদের উপর দুপ্‌ দাপ্‌।
    আকাশ ঘেরিয়াছে মেঘে,
    জোলো হাওয়া বহে বেগে,
    ছেলেরা বেরতে না পেয়ে, রেগে
    ঘরের ভিতরে করে হুপ্‌ হাপ্‌।
    ...
    বৃষ্টি নামিল তোড়ে;
    রাস্তা কর্দ্দমে পোরে;
    ছত্র মস্তকে রাস্তার মোড়ে
    পিছলে পড়ে সবে ঢুপ্‌ ঢাপ্‌।
    ভিজেছে নির্ঝুম শাখী,
    শালিক ফিঙে টিয়া পাখী,
    আমি কি করি ভেবে না পেয়ে, একাকী -
    ঘরেতে বসে আছি চুপ্‌ চাপ্‌।” - ‘বর্ষা’, “হাসির গান” (১৯০০)
    আসলে সকল ঋতুর মধ্যে বর্ষা ও বসন্তের সঙ্গে যেন বিশেষ সম্পর্ক আছে কবিদের। এ সম্পর্ক তাঁদের রচনার ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ থেকে ‘মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে...’ পর্বের সূত্রপাতেই লক্ষ্য করা যায়। অনেক কবির বাল্যরচনায় প্রাধান্য তাই প্রকৃতি-বর্ণনার। সেখানে প্রাধান্য আবার বর্ষা অথবা বসন্তের। বালক মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)-ও ব্যতিক্রম ছিলেন না এ ক্ষেত্রে। তাঁর বাল্যরচনা-সঙ্কলনের প্রথমেই রয়েছে ‘বর্ষাকাল’ -
    “গভীর গর্জন সদা করে জলধর,
    উথলিল নদনদী ধরণী উপর।
    রমণী রমণ লয়ে, সুখে কেলি করে,
    দানবাদি, দেব, যক্ষ সুখিত অন্তরে।
    সমীরণ ঘন ঘন ঝন ঝন রব,
    বরুণ প্রবল দেখি প্রবল প্রভাব।
    স্বাধীন হইয়া পাছে পরাধীন হয়,
    কলহ করয়ে কোন মতে শান্ত নয় ॥”
    তবে বর্ষার প্রকৃত রূপ স্যাঁতসেঁতে শহরের বাইরে বিশাল বাংলায়। সেখানে আকাশ-ঢালা উদার বর্ষণ, কল-কল ছল-ছল নদী, জল থৈ থৈ বিল-ঝিল হাওড়-বাঁওড়, প্রকৃতির শ্যামল শোভা, ফুল ফল ফসলের উচ্ছ্বাস। মধুসূদনের সার্থক উত্তরসূরি ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪) লিখেছেন:
    “বৃষ্টি এল... বহুপ্রতীক্ষিত বৃষ্টি! - পদ্মা মেঘনার
    দু’পাশে আবাদি গ্রামে, বৃষ্টি এল পুবের হাওয়ায়,
    বিদগ্ধ আকাশ, মাঠ ঢেকে গেল কাজল ছায়ায়;
    বিদ্যুৎ-রূপসী পরী মেঘে-মেঘে হয়েছে সওয়ার।
    দিকদিগন্তের পথে অপরূপ আভা দেখে তার
    বর্ষণ-মুখর দিনে অরণ্যের কেয়া শিহরায়,
    রৌদ্র-দগ্ধ ধানক্ষেত আজ তার স্পর্শ পেতে চায়,
    নদীর ফাটলে বন্যা আনে পূর্ণ প্রাণের জোয়ার।...” - ‘বৃষ্টি’, “মুহূর্তের কবিতা” (১৯৬৩)
    বর্ষা যেন বাংলার পূর্ণপ্রাণ জাগরণ, জনসত্তার বিপুল প্রকাশ - কবিতার এ মর্মবাণী এ দেশের প্রকৃতিলগ্ন মানুষের জীবনে আবহমানকাল ধরেই সত্য। হাজার বছরের মৃত্যু ধ্বংস বিপর্যয় জয় করে এ সত্য অক্ষয় অমর হয়ে আছে গ্রামবাংলার সমাজনিসর্গে। এ জীবনে বর্ষা-দিনের অন্তরঙ্গ ছবি এঁকেছেন প্রাণবাংলার কবি জসীম উদ্‌দীন (১৯০৪-১০৭৬):
    “আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলাটে-মেঘের আড়ে,
    কেয়া-বন-পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে।
    কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝ্‌ঝুম নিরালায়,
    ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!
    বাদলের জলে নাহিয়া সে-মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়,
    সে-হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়।
    কাননের পথে লহর খেলিছে অবিরাম জল-ধারা
    তারি স্রোতে আজি শুক্‌নো পাতারা ছুটিয়াছে ঘরছাড়া।...
    গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়, -
    গল্পের গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!
    কেউ বসে বসে বাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রসি,
    কেউবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাকা বাঁধে কসি কসি।
    কেউ তুলিতেছে বাঁশের লাঠিতে সুন্দর করে ফুল
    কেউবা গড়িছে সারিন্দা এক কাঠ কেটে নির্ভুল।
    মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ, করুণ ভাটীর সুরে,
    আমীর সাধুর কাহিনী কহিছে সারাটি দলিজা জুড়ে।...
    বউদের আজ কোনও কাজ নাই, বেড়ায় বাঁধিয়া রসি,
    সমুদ্রকলি শিকা বুনাইয়া নীরবে দেখিছে বসি।
    কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপনখানি,
    তারে ভাষা দেয় দীঘল সূতার মায়াবী নক্‌সা টানি।
    বৈদেশী কোন বন্ধুর লাগি মন তার কেঁদে ফেরে,
    মিঠে-সুরি-গান কাঁপিয়ে রঙিন ঠোঁটের বাঁধন ছেঁড়ে।
    আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে,
    বেণু-বনে বায়ু নাড়ে  এলোকেশ, মন যেন চায় কারে।”- ‘পল্লী-বর্ষা’, “ধানখেত” (১৯৩৩)
    বর্ষা শুধু প্রকৃতিরই এক রূপবৈচিত্র্য নয়, এর সঙ্গে গভীর সংযোগ রয়েছে জনজীবনের, মানুষের একান্ত আবেগ-অনুভূতিরও। এ জন্য কবির বর্ণনা কেবল বর্ষণমুখর দিন-রাতের দৃশ্যরচনায় সীমিত থাকে না, নর-নারীর অন্তরলোকের নিভৃত অভিব্যক্তিতেও সুন্দর-বিধুর হয়ে ওঠে। প্রাচীন কাব্যের বর্ষাকে আমরা দেখি বিরহী হৃদয়ের বিষাদে আচ্ছন্ন, কিন্তু মধ্যযুগের বৈষ্ণব কবিতায় বর্ষা প্রিয়-সান্নিধ্যে আকুল অভিসারে চকিত চমকে বিহ্বল, আবার বিরহ-জর্জর বেদনায় মধুর। যুগান্তরে রূপান্তরে পরিবেশ পরিস্থিতি ভিন্ন স্বতন্ত্র, তবুও একালের কবিতায়ও বর্ষা ঐতিহ্যচ্যুত হয় নি, - নাগরিক দুর্ভোগ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে চিরদিনের মিলনপিয়াসী বিরহী, অধীর ব্যাকুল অভিসারিকা রূপেই তাকে দেখি। তবে কৌতুক-রহস্যপ্রিয় বাঙালি এ ঋতুতে কেবল বর্ষণে নয়, সিক্ত থাকে রসেও। তাই নিজের বর্ষা বিষয়ক কবিতাকে প্যারোডি করে রসমধুর চা-বন্দনাগীতি লিখতে পারেন রবীন্দ্রনাথ:
    “হায় হায় হায় দিন চলি যায়।
    চা-স্পৃহ চঞ্চল চাতকদল চল চল চল হে ॥
    টগবগ-উচ্ছল কাথলিতল-জল কলকল হে ॥
    এল চীনগগন হতে পূর্বপবনস্রোতে শ্যামলরসধরপুঞ্জ ॥
    শ্রাবণবাসরে রস ঝরঝর ঝরে, ভুঞ্জ হে ভুঞ্জ দলবল হে ॥...” (‘বিচিত্র’)

sazzadqadir@rediffmail.com

1 টি মন্তব্য: