বুধবার, ৪ এপ্রিল, ২০১২

বৈশাখে বইমেলা

প্রতি বছর বৈশাখে আসে বইমেলা, এর একটু আগে আসে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’, সেই সঙ্গে নানা সেমিনার-সিমপোজিয়াম আসে গ্রন্থের প্রসার নিয়ে ভাবনা করতে। উদ্যোগ নেই কোনও, কিন্তু ভাবনা কেন?
    আঠারো শতকে প্রতাপ ও প্রতিষ্ঠা ছিল পুঁথির। ধর্মকর্ম, রাজকার্য, শিক্ষা ও সাহিত্য - সব কিছুর এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে পুঁথির প্রসার ছিল পরাক্রমশালীর প্রাসাদ থেকে আলোকপ্রাপ্ত দরিদ্রের পর্ণকুটির পর্যন্ত। তারপর উনিশ শতকে গ্রন্থের প্রতিষ্ঠা ঘটে অন্য সব মাধ্যমকে ছাড়িয়ে। উন্নত কাগজ, পরিপাটি মুদ্রণ, মজবুত বাঁধাই, বিষয়বৈচিত্র্যে অনন্য রচনা, মেধাবী পাঠক - গুণে মানে গ্রন্থের মহিমা তখন সর্বশীর্ষে। কিন্তু বিশ শতকে প্রবল প্রতাপ অডিও-ভিসুয়াল মাধ্যমের। একে-একে সংবাদপত্র, চলচ্চিত্র, গ্রামোফোন, বেতার ও মঞ্চনাটক অনেকখানি দখল করে নেয় গ্রন্থজগতের জায়গাজমি, লেখক-পাঠকদের সময়। এক কাজী নজরুল ইসলামের উদাহরণ দিয়েই বলতে পারি - তাঁর মতো একজন যুগন্ধর কবি কিভাবে জড়িত ছিলেন ওই সব মাধ্যমের প্রতিটির সঙ্গে। তারপর এসেছে টেলিভিশন, ক্যাসেট, সিডি, ভিসিডি, ডিভিডি, কমপিউটার, সেলফোন। আরও আসছে কত। বিশ শতক যদি হয় টেলিভিশনের শতক, তাহলে এই একুশ শতক অবশ্যই কমপিউটারের।
এ অবস্থায় গ্রন্থের প্রসারের প্রশ্নটি আসতেই পারে। গত শতকে কোণঠাসা হওয়ার পর এ শতকে চ্যালেঞ্জেই পড়েছে সে। বিল গেটস তো বলেছেনই - কাগজের ব্যবহার থাকবে না এক সময়। এখনই অনলাইন প্রকাশনা এগিয়ে গেছে অনেকখানি। এ অবস্থায় সংবাদপত্র জগতে বিপর্যয় শুরু হয়েছে, আর গ্রন্থ জগৎ অপেক্ষা করছে আসন্ন পরিস্থিতির। কারণ “গুটেনবার্গ দানো”র মহিমা ছাড়াও অল্প আয়াস নির্ভর পাঠ্যপুস্তকের জগৎ এখনও অনেকখানি ভরসা হয়ে আছে তার।
তাহলে কি ভূমিকা রাখতে পারেন লেখক? গ্রন্থজগতে বিরাজমান প্রতিকূলতা কাটিয়ে প্রসারতা ঘটাতে কি করতে হবে লেখককে? যাঁরা পাঠ্য বই লেখেন তাঁদের পরিচিতিই বড় ভূমিকা রাখে ওই বইয়ের প্রচার ও প্রসারে। কারণ পরিচিতির সূত্রে নানারকম যোগাযোগ থাকে, আর ওই যোগাযোগটাকে অর্থপূর্ণ করা গেলে কাজটা সহজ হয় বেশ। কিন্তু “অপাঠ্য” বইয়ের লেখক - তাঁদের ভূমিকা কেমন?
সব লেখকের কাছেই প্রিয় তাঁর নিজের লেখা। এই প্রিয়তা নিয়ে তিনি যে ভূমিকা পালন করেন তা অনেকটা কন্যার পিতার মতো। কন্যাকে কেবল জন্ম দিলেই চলে না, তাকে সৎপাত্রস্থও করতে হয়। লেখকও সে রকম এক দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধ নিয়ে নিজের লেখাটি ভালভাবে প্রকাশ করতে চান, উদ্দিষ্ট পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে চান।
তবে কোনও-কোনও লেখককে প্রকাশকরাও খোঁজেন, কিন্তু অনেক লেখকই ভাল একজন প্রকাশক খোঁজেন। এই অনেক লেখকদের অনেকে নানাভাবে সহায়তাও করেন প্রকাশকদের। তাঁরা অঙ্কনশিল্পীদের ধরে প্রচ্ছদ করিয়ে নেন, পত্রপত্রিকায় ঘুরে-ঘুরে খবর ছাপান, বিজ্ঞাপন ছাপান, মোড়ক উন্মোচন বা প্রকাশনা উৎসব করেন, রাস্তার মোড়ে-মোড়ে ব্যানার ঝোলান, বইমেলায় বিক্রেতা সাজেন।
কোনও-কোনও লেখক করেন আরও বেশি। তাঁরা টিভি-অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, বিশাল-বিশাল হোরডিং লাগান রাজপথের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে, পুরস্কার আদায় বা যোগাড় করেন।
তবে “অপাঠ্য” বইয়ের বেশির ভাগ লেখককেই নিজের বই ছাপতে হয় নিজেকে। প্রচার, বিক্রয়ও করতে হয় নিজের উদ্যোগে। এতে অবশ্য লজ্জা বা সঙ্কোচের কিছু নেই। প্রথম দিকে দু’একটি ব্যতিক্রম বাদে রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন নিজের বই নিজেই ছেপেছেন, নজরুলও ছিলেন নিজের অনেক বইয়ের প্রকাশক।
আরও অনেক লেখক আছেন যাঁদের বই ছাপা হয় না কখনও। প্রকাশকরা ছাপেন না তাঁদের বই, নিজেদেরও সংগতি নেই ছেপে বের করার। হঠাৎ কখনও কোনও মতে তাঁদের দু’একজনের দু’একটি বই বের হলেও তা হয়তো থেকে যায় পাঠকদের অজানাই।
আসলে শিক্ষা ও বিনোদন - এ দু’টি চাহিদার একচেটিয়া যোগান গত এক শতক ধরে আর গ্রন্থে নেই। ভোক্তারা এখন তা পাচ্ছেন অন্যান্য অনেক মাধ্যমেই। বই পড়ার সময়গুলোও দখল হয়ে গেছে নানাভাবে। তারপরও পাঠক-ক্রেতারা আসছেন বইমেলায়, খুঁজছেন তাঁদের মনের মতো বই। কোনও বইয়ের প্রয়োজন জীবন-জীবিকার কাজে, কোনও বইয়ের চাহিদা মনের খোরাক মেটাতে। এ সব প্রযোজন ও চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে লেখক ও প্রকাশকরা ব্যস্ত রেখেছেন নিজেদের।
উনিশ শতকের শেষ পাদে সেরাকাটতি মানে বেস্টসেলার লেখক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪)। কিন্তু তাঁকে বেস্টসেলার লেখক বানিয়েছিলেন কারা? কারা ছিলেন সেই পাঠক-ক্রেতা? সুকুমার সেন (১৯০১-৯২)  তাঁর বিখ্যাত “বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস”-এর তৃতীয় খণ্ডে (কলকাতা, ১৯৪৩) উল্লেখ করেছেন, “যে সকল পাঠক সংস্কৃত সাহিত্যের অথবা সংস্কৃতানুসারী বাঙ্গালা সাহিত্যের ধার বিশেষ ধারিতেন না অথচ ইংরেজী সাহিত্যে তেমন দখল না থাকায় যাঁহারা বাঙ্গালা বই পড়া অবজ্ঞেয় কাজ মনে করিতেন না তাঁহারাই বঙ্কিমের প্রধান সমঝদার ছিলেন, এবং স্বভাবতই ইঁহাদের মধ্যে দলে ভারী ছিলেন নারী ও তরুণেরা।”
আমার ধারণা গত প্রায় দেড় শ’ বছর ধরে পাঠক-ক্রেতা সমাজে দলে ভারি হয়ে আছেন এই কলেজপড়ুয়ারা, এই গৃহিণীরা। তাঁরা সমকালীন বুদ্ধিজীবীদের ঠাট্টা-মশকরা উপেক্ষা করে সেই তখন থেকে পড়ে আসছেন বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, বিভূতি-তারাশঙ্কর, সুবোধ ঘোষ-বিমল মিত্র, শংকর-সুনীল। পাশাপাশি পড়েছেন পাঁচকড়ি দে, দীনেন্দ্রকুমার রায়, শশধর দত্ত, স্বপনকুমার। প্রভাবতী দেবী, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, অবধূত, জরাসন্ধ, নিমাই ভট্টাচার্য-ও পড়েছেন। সে পড়াও হয়তো বৃথা যাবে না তাঁদের। একদিন পুনর্মূল্যায়ন, পুনঃপ্রতিষ্ঠা হতে পারে এই উপেক্ষিত লেখকদেরও।
গ্রন্থের প্রসারে প্রচারমাধ্যমের ভূমিকা আগের চেয়ে অনেক জোরালো এখন। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক উভয় মাধ্যম কারিগরি উৎকর্ষের কারণে জোরদার হয়ে উঠছে প্রতিদিন। বড়-বড় হাউস প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, নতুন-নতুন ভেন্যু খুলে যাচ্ছে - আর এ সবের সবখানে যথামহিমা ও যথামর্যাদায় পাতা আছে গ্রন্থজগতের আসনটি। সরাসরি সমপ্রচার হচ্ছে বইমেলা, টক শো হচ্ছে নিয়মিত, আলোচনা-পরিচিতির আয়োজন আছে, স্বল্পমূল্যে বিজ্ঞাপনেরও ব্যবস্থা আছে।
এ পর্যন্ত সব খবরই ভাল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সব খবরই ভাল নয়। সব কিছুও ভাল নয়।
প্রথমত, যত ভাল বই পড়বো বলে আশা করি অত ভাল বই প্রকাশ হয় না।  মেধাবী ও শ্রমনিষ্ঠ লেখকের সংখ্যা কম। যাঁরা আছেন তাঁরা শৌখিন লেখক ও ধান্দাবাজদের উৎপাতে প্রায় কোণঠাসা। এই ধান্দাবাজরা নানা দল ও গোষ্ঠীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে তালে থাকেন নগদ ফায়দা লোটার। তাঁরা দলাদলি করে একে ওঠান, ওকে নামান - একে হটান, ওকে কাটেন! মারকা মেরে, লেবেল এঁটে বেড়ান তাঁরা, অপপ্রচার চালিয়ে খুনও করেন।
দ্বিতীয়ত, লেখালেখি ক্রমশ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে চর্চাকারীদের মধ্যে। যাঁরা লেখেন কেবল তাঁরাই পড়েন। তাঁদেরও পড়ার অভ্যাস সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে ক্রমে। কেউ-কেউ নিজের লেখাই শুধু পড়েন। প্রয়োজন বা ঠেকায় না পড়লে অন্যের লেখা ছুঁয়েও দেখেন না।
তৃতীয়ত, প্রচারমাধ্যমে চেনামুখেরই ছড়াছড়ি বেশি। সেখানে গোষ্ঠীপ্রীতি ছাড়াও আছে অঘোষিত কালো তালিকা।
অথচ লেখকদের ব্যাপারে আমাদের আশা অনেক। বিশ্বাস করি, তাঁরা বিশেষ কোনও দলের নন, দেশ জাতি জনগণের, গোটা বিশ্বসমাজের। দুঃখজনক হলেও সত্য - এ দেশের অনেক লেখক চলেন বলেন দলীয় মুখপত্র বা মুখপাত্রের মতো, অনেকের আচরণ দলের উপজেলা পর্যায়ের অঙ্গসংগঠনের কর্মীদের চেয়েও খারাপ। এ অবস্থায় লেখালেখির চেয়ে কোন্দলের কোলাহলই সৃষ্টি হয় বেশি, আর এর আছর পড়ে বইয়ের প্রকাশ, প্রচার, প্রসারের ওপর।
অনেকে বলবেন, প্রকৃত লেখকের প্রাপ্য তো বৈরিতা ও তিরস্কার - সমর্থন বা পুরস্কার নয়। কারণ সুন্দরী মহিলাদের বান্ধবী থাকে না, প্রতিভাবান পুরুষদের বন্ধু থাকে না - এটা বাস্তবতা। প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে বলেই এমনটা ঘটে। সাহিত্যসম্রাট হিসেবে নন্দিত বন্দিত যে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকেও একদিন গভীর দুঃখে বলতে হয়েছে, “নিরপেক্ষ সমালোচনায় একটা দেশ আমার শত্রু হইয়া উঠিতেছিল। শুনিয়াছি, কোনও কোনও গ্রন্থকার আমাকে মারিতে পর্যন্ত সংকল্প করিয়াছিল। গালাগালির ত কথাই নাই। সার্‌ জর্জ কেম্বেলের পর বোধ হয়, আমি এ বাঙ্গালার গালাগালির প্রধান পাত্র - ও ধস ঃযব ড়িৎংঃ ধনঁংবফ সধহ রহ ইবহমধষ হবীঃ ড়হষু ঃড় ঝরৎ এবড়ৎমব ঈধসঢ়নবষষ.চ
প্রচারমাধ্যম আরও প্রচারনিরপেক্ষ হবে - এটুকু আমরা আশা করতে পারি। এতে গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে তাদের। এছাড়া অতিপ্রচার যে এক ধরনের অপপ্রচার তা অতীতে যেমন বারবার প্রমাণিত হয়েছে, ভবিষ্যতেও তেমন প্রমাণিত হবে বারবার। এ সত্যটি জানা থাকলে চেনামুখের দৌরাত্ম্য ও কালো তালিকার দাপট বন্ধ হবে এমনিতেই।
সবশেষে বলি, গ্রন্থের প্রসারে অতীতে অনেক উদযোগ নেয়া হয়েছে, এখনও কিছু-কিছু উদযোগ চালু আছে। এসব উদযোগের অপব্যবহার সম্পর্কে অনেক অভিযোগ আমরা শুনেছি, পড়েছি এবং জেনেছি। সরকারি উদযোগে বই কেনার নিয়ম কিভাবে পালিত হচ্ছে তা খোঁজ না নিয়েও জানা যায় এমনিতে। এ নিয়ম তৈরি করেছে ঢের-ঢের অ-প্রকাশক আর অ-লেখক। আর যে সব প্রতিষ্ঠান কিছু-কিছু বই কেনে সেখানেও চলছে ইচ্ছামতো বাছবিচার। দলাদলি। রাজনৈতিক খেয়োখেয়ি। ফলে আবর্জনায় ভরে উঠছে সারা দেশের বহু আলমারি। সে আবর্জনার অবশ্য সতূপে যেতেও দেরি হয় না বেশি।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও চলছে একই অবস্থা। স্কুলের শিশুদের জন্য উন্নত মানের শিক্ষামূলক জ্ঞানচর্চার বই রেখে কেনা হচ্ছে নিম্নমানের অর্থহীন বিনোদনমূলক রঙচঙা বই। বানান ভুল, ভাষা ভুল ? এ সব বই এক শিক্ষিকাকে কিনতে দেখে বলেছিলাম, এর থেকে তো বিষ কিনে দেয়াই ভাল! তিনি বলেন, ওরা এগুলোই চায়।
শিশুদের রুচিনির্মাণের দায়িত্ব যাঁদের ওপর তাঁরা যদি শিশুরুচির কাছেই আত্মসমর্পণ করেন তাহলে পাঠকরুচি গড়বেন কারা? এ রুচি ছাড়া কি প্রসার হওয়া সম্ভব সৃষ্টিশীল সাহিত্যের? বৈশাখে তাই বইমেলা হোক বিশেষভাবে রুচিশীল বইয়ের।
sazzadqadir@gmail.com; sazzadqadir@rediffmail.com; sazzadqadir@yahoo.com; facebook.com/sazpa85


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন