সোমবার, ৯ এপ্রিল, ২০১২

মুখোমুখি

‘কবিতায় থাকে এক গোপন জাদু’
১লা বৈশাখ ৬৫তম জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ সাক্ষাৎকার

কবি সাযযাদ কাদির বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এক বহুদর্শী ব্যক্তিত্ব। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় তাঁর সৃষ্টিশীল বিচরণ বিস্ময় জাগায় পাঠকদের। শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, সম্পাদনার কারণেও খ্যাতিমান তিনি।  ১৪ই এপ্রিল ১৯৪৭ সালে তাঁর জন্ম মাতুলালয় টাঙ্গাইল জেলা-শহরের উপকণ্ঠ-গ্রাম মিরের বেতকায়। পিত্রালয় একই জেলার দেলদুয়ার উপজেলার সদরে। ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স ও এম এ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিভিন্ন বিষয়ে ৬০টির বেশি গ্রন্থের প্রণেতা সাযযাদ কাদিরের একাদশ কবিতাগ্রন্থ “বৃষ্টিবিলীন” প্রকাশিত হয়েছে গত অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। সাহিত্য সংস্কৃতি, সমকালীন প্রসঙ্গ সহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন সুবর্ণ আহসান। তাঁর ৬৫তম জন্মদিন উপলক্ষে সে আলোচনার উল্লেখযোগ্য অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো এখানে:

সুবর্ণ আহসান: ১৯৪৭ থেকে আজ পর্যন্ত জীবনের যে পরিক্রমা, তা কিভাবে উপভোগ করছেন?
সাযযাদ কাদির: কোন অর্থে বলছো, এই যে বেঁচে থাকা? মানে বেঁচে আছি কিভাবে?
: আপনি যে কাজ করছেন, আপনার কর্মক্ষেত্রটাকে কিভাবে উপভোগ করছেন?
? আমি তো এখন সাংবাদিকতা-সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। দৈনিক মানবজমিন-এর যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এখানে কাজ নিয়ে আমার কোনও অভিযোগ-অনুযোগ নেই।
: এই দীর্ঘ সময়ে তো আপনি অধ্যাপনা থেকে শুরু করে নানান পেশায় কাজ করেছেন?
?  শিক্ষকতা করেছি, সাংবাদিকতা করেছি। আর তো অন্য কোনও পেশায় ছিলাম না। এ দু’টোই করেছি।
: আর যদি বলি যে, পাশাপাশি যে লেখক সত্তা সেই সম্পর্কে কি কিছু বলবেন?
?  ওটা তো আর পেশা হিসেবে নিতে পারি নি। ওটা তো মনের আনন্দে করি। ওটা এক সৃষ্টিশীল প্রবণতা। আমার ভেতর যে সৃষ্টিশীল একটা মন তা সকল মানুষের মধ্যেই আছে। সৃষ্টিশীল মানুষ কিছু প্রকাশ করতে চায়, লেখালেখি সে প্রকাশের চেষ্টা।
: বাংলাদেশে কি পেশাগত ভাবে লেখক হওয়ার সুযোগ আছে?
? আছে হয়তো। আমি কিছু আয় করতে পারি নি লিখে।
: একটা কবিতায় বলেছেন, কবিতা জীবন না শিল্প। এ দু’টোর কোনটাকে আপনি মনে করেন কবিতা ? জীবন না শিল্প? নাকি অন্য কোনও সংজ্ঞায় কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করবেন?
?  কবিতা জীবন থেকেই আসে। রচনাটা শিল্প, বিষয়টা জীবন। নির্মাণ ব্যাপারটা তো শিল্প। তারপরও কবিতাকে ঠিক ব্যাখ্যা করা যায় না। কেন ভাল লাগলো, কেন লাগলো না, কেন একটা কথা কবিতা হয়ে ওঠে ? এটা তো ব্যাখ্যা করা যায় না। এ অনুভূতির ব্যাখ্যা করা যায় না। এজন্য বলেছি কোনও এক গোপন জাদু আছে এতে।
: বিভিন্ন জন  বিভিন্ন ভাবে কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। কেউ কথাকে বলেছেন কবিতা।
?  সব কবি’র কাছে, সব সমালোচকের কাছে কবিতার সংজ্ঞা আছে, ব্যাখ্যা আছে। তবে কবিতার সংজ্ঞা কবিতার ব্যাখ্যা দিয়ে তো আর কবিতার স্বাদ পাওয়া যায় না। আলোচনা থাকবেই। কবিতার আলোচনা তো কবিতা না। একটা হলো লজিক, আরেকটা হলো ম্যাজিক। কবিতা যদি ম্যাজিক হয়, কবিতার আলোচনা লজিক।
: “সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি” কথাটা কি সমর্থন করেন?
?    জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন। আমি এটা বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি ?  সকলেই কবি, কেউ কেউ কবি নন।
: সকলেই কবি, বিষয়টি কি একটু ব্যাখ্যা করবেন?
?    কবিমন কার নেই? জীবন-যাপন, কষ্ট, দুঃখ, প্রকৃতি সব নিয়ে এই যে আমরা  ?  আমাদের সবার মধ্যেই আছে কবিমন। একেক জনের প্রকাশ একেক রকম। তবে কিছু আছে যারা কবি নয়। দুর্বৃত্ত, ধান্দাবাজ তারা। এই আর কি!
: কবি ও অকবি ?  এই দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য কোথায় করবেন?
? সাহিত্য জগতে শিক্ষিত... সুশিক্ষিত... স্বশিক্ষিত মানুষ আছেন। অল্পশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত আবার অশিক্ষিতও আছে। কিন্তু কুশিক্ষিত যারা আমার মতে তারাই অকবি।
: আপনি গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ সহ বিভিন্ন শাখায় লিখেছেন। কোন শাখায় লিখতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন?
? স্বচ্ছন্দ বোধ না করলে তো লেখাই যায় না। তাই না? আমি যদি স্বচ্ছন্দ বোধ না করি তাহলে লিখতেই পারবো না। প্রবন্ধ নিবন্ধ গল্প কবিতা যা-ই লিখি না কেন সেটা মনে আসে প্রথম। তারপর সেটা মনে মনে লেখা হতে থাকে। লেখা হয়েও যায়। এর পরের কাজ হলো সেটাকে প্রকাশ করা।
: কেউ কেউ বলেন যে, লিখতে গেলে মনে হয় কেউ কাজটা তাকে করিয়ে নিচ্ছে। এ রকম কোন অনুভুতি কি কখনও হয়?
? মনে একটা ভাবনা আসে। থাকে। চলতে ফিরতে সবসময় যে থাকে তা নয়। ভাবনা আসার পর মনে-মনে তা নিয়ে ভাবতে থাকি, মনে-মনে রচনা করতে থাকি, কিভাবে কি লিখতে পারি। এ কাজটা চলতে থাকে ভেতরে-ভেতরে। তারপর একটা পর্যায়ে গিয়ে দেখা গেল যে আমি লিখছি। এটা লিখছি সম্পূর্ণ নিজের জন্য। আমিই স্রষ্টা, আমিই কর্তা। আমাকে কেউ গাইড করার নেই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন কে যেন তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে। এ রকম কিছুতে আমার বিশ্বাস নেই। আমি নিজেই তো লিখছি সব। অলৌকিক অপ্রাকৃত কোনও কিছুতে বিশ্বাস করি না।
    : আপনার বাল্যবন্ধু বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম লিখেছেন, আপনি ছেলেবেলায় বেশ দুরন্ত ছিলেন। সেই ছেলেবেলার কথা মনে করে কি নসটালজিয়ায় ভোগেন?
? নসটালজিয়া কিছু না। ছেলেবেলার কথা ভেবে সবাই আনন্দ পায়। আমিও পাই। তখনকার কথা মনে করি। স্মৃতি তো সুখের। স্মৃতি সবসময়ই সুখের। তখন দুঃখেরও অনেক কিছু ছিল। কিন্তু আমরা দুঃখের কথা ভুলে যাই। বজ্র মানে কাদের সিদ্দিকীর লেখার কারণ আমরা খেলার সাথি ছিলাম। একসাথে খেলাধুলা করেছি। সেইসব খেলায় আমার কিছু সাফল্য ছিল। ভাল ফুটবলার ছিলাম। গোল দিতে পারতাম। এজন্য আমার সুনাম ছিল। ফুটবল, ক্রিকেট ও অন্যান্য খেলাধুলার পাশাপাশি পাড়ায় নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছি। সেসবে আমার কিছু না কিছু ভূমিকা ছিল। এছাড়া ক্লাসে  ফার্স্ট বয় ছিলাম। লেখাপড়ায় ভাল ছিলাম। তবে বজ্র আমার চেয়ে বেশি অ্যাকটিভ ছিল। আর সমবয়সী হলেও ও তো গায়েগতরে আমাদের ছাড়িয়ে। আমি একটা গোল দিলে খুশিতে সে আমাকে কাঁধে নিয়ে লাফাতো। ওই বয়সের বন্ধুত্বের কোনও তুলনা হয় না।
: লেখালেখির শুরুর দিকটার কথা  জানতে চাই, কারও অনুপ্রেরণা ছিল এর পেছনে?
? বিশেষ কারও নেই। অনুপ্রেরণা দেয়ার মতো অমন কেউ আমাদের পরিবারে ছিল না, চারপাশেও নেই, আমি আসলে খুব বিচ্ছিন্ন পরিবেশে বড় হয়েছি। লেখালেখির কোন ব্যাপারই ছিল না সেখানে। আমার অনুপ্রেরণা এসেছে পাঠ্যবই থেকে। পাঠ্যবইগুলোর মধ্যে বিশেষ করে ইংরেজি ও বাংলা গদ্য-পদ্য আর র‌্যাপিড রিডার ও দ্রুতপঠনের বই। ফোর-ফাইভে যখন পড়ি তখন থেকেই মুখে-মুখে ছড়া কাটা আর পদ্য মিলানোর অভ্যাস ছিল।
:লেখক হয়ে উঠতে কি-কি গুণ থাকা দরকার?
? অধ্যয়ন ও অনুশীলনে নিবেদিত থাকতে হবে, অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। দেশ, জাতি, সমাজের প্রতি অঙ্গীকার থাকতে হবে।
: এক কথায় যদি বাংলাদেশ সম্পর্কে বলতে বলি তা হলে কি বলবেন?
? আমাদের প্রচুর সম্ভাবনা আছে, কিন্তু প্রকৃত উদ্যোগ নেই। দুর্নীতি কুরে-কুরে খাচ্ছে সব কিছু।
: আপনার কাজের সফলতা কতটুকু বলে মনে করেন?
? সফলতা নেই। জীবনে কাজে সফলতা বলতে কিছু নেই। আছে একটা সম্ভাবনা। তারপরও এটুকু বলতে পারি ? লেখার ভাব, ভাষা ও নির্মাণ ? এই তিনটা ক্ষেত্রেই নতুনত্ব আমার আছে। আমি তো অন্য কারও মত না। আমার আগের বা আমার সমসাময়িক কারও মতো নই। আমার লেখা এখন না হলেও এক সময় ঠিকই সমাদর পাবে। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। মিডিয়ার জেল্লায় আমি ভুলি না। জানি, স্রোতে মরা মাছই ভাসে।
: পাঠকের কাছে আপনার চাওয়া কি?
? আমার চাওয়া তাঁরা ভাল লেখা পড়ুক, ভাল লেখার পৃষ্ঠপোষকতা করুক।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: ২৮শে মার্চ, ২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন