রবিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১২

জলা-নালা জয়ের জন্য

দু’ দশকেরও বেশি হলো আমাদের দেশে দু’টি বড় রাজনৈতিক দল ক্ষমতা ভোগ করছে পালাক্রমে। পর-পর দু’বার ক্ষমতা ভোগের জন্য যৎপরোনাস্তি চেষ্টা চালালেও এখনও সফল হন নি তাঁরা। সম্ভবত যত বড় ভাবা হয় অত বড় দল নয় বলেই এমনটি ঘটে।  অত বড় নয় বলছি, কারণ ছোট-ছোট দলের সঙ্গে জোট গড়তে হয় তাঁদের। এছাড়া ছোটদের জোটে রাখাও জরুরি। নাহলে ছোটরা সব মিলেঝুলে বড় জোট গড়ে একদিন তারাও বড় দল হয়ে উঠতে পারে। সেটা ভাল হবে না দুই বড়’র জন্য। কিন্তু রাজনীতির নামে এই দুই বড় পরস্পরের প্রতি যে রকম মারমুখো তাতে পরিস্থিতি সেদিকেই যাবে শিগগিরই - এমন মনে করার কারণ আছে যথেষ্ট। তাদের বেপরোয়া বিরোধিতা সব ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিয়েছে নেতিবাচক মনোভাব, সন্দেহ, অবিশ্বাস, অসষ্ণিুতা, আক্রোশ, ঘৃণা। আর এসব সূত্রে দেখা দিচ্ছে সহিংসতা। জ্বালাও পোড়াও ভাঙচুর হানাহানি সংঘাত সংঘর্ষ হামলা মামলা হরতাল ধর্মঘট। গরিব দেশের জন্য এ সব চরম বিলাসিতা। দু’দলের নেতাকর্মীদের অহমিকা অনাচার দুরাচার প্রতিশোধ প্রতিহিংসার জন্য দেশের সম্পদ বিনষ্ট হবে, প্রশাসন ব্যতিব্যস্ত থাকবে, ব্যবসা বাণিজ্য শিক্ষা সহ সকল আর্থসামাজিক কার্যক্রম হুমকির মুখে পড়বে - আর কত দিন দেশ জাতি জনগণের এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি নিত্য সইবে মানুষ? ভারতচন্দ্রের ভাষায় বলি, “নিত্য তুমি খেলো যাহা। নিত্য ভাল নহে তাহা ॥”
    দু’ দলের সর্বশেষ খেলা এখন চলছে সাগরের জয়-পরাজয় নিয়ে। সরকার বলছে, মিয়ানমারের সঙ্গে সাগরসীমা সংক্রান্ত বিরোধে আন্তর্জাতিক আদালত যে রায় দিয়েছে তা বাংলাদেশের পক্ষে এসেছে। এ জয় বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় উদযাপন করছে সরকারি দল। অভিনন্দন, সংবর্ধনা, অভ্যর্থনা চলছে। অভিনন্দন প্রথমে বিরোধী দলও জানিয়েছিল, পরে প্রত্যাহার করে নিয়ে বলেছে, এটা বিজয় নয়... শুভঙ্করের ফাঁকি। বিজয় হলে মিয়ানমার-ও কেন উৎসব করছে? পত্রপত্রিকায় নানা তথ্য-উপাত্ত আসছে এ সব নিয়ে। সরকারের প্রতি আমার অভিনন্দন প্রত্যাহার করি নি আমি, কিন্তু বুঝতে পারছি না ঘটনা কি। দু’দল এভাবেই আমাকে, আমার মতো অনেককে, দেশবাসীকে বিমূঢ় বিভ্রান্ত করে রাখে প্রায় সব বিষয়েই। তাঁরা পরস্পর সম্পর্কে যে সব কথা বলেন সে সব বিশ্বাস করলে বলতে হয় - আমরা এক ভয়ঙ্কর সময়ে বাস করছি ভয়ঙ্কর লোকজনের সঙ্গে।
    যাহোক, সাগরে আমাদের জয়-পরাজয় নিয়ে খোঁজাখুঁজি করি সংবাদমাধ্যমে। নানা প্রতিবেদন, মন্তব্য, মতামত পড়ি। মিয়ানমারের অনলাইন সংবাদপত্র দি ইরাবতী’র গত ১৫ই মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত জোসেফ আলচিন-এর প্রতিবেদন “বাংলাদেশ ক্লেইমস্‌ ভিক্টরি ইন বে অভ বেঙ্গল ডিসপিউট”  (www2.irrawaddy.org.article.php)-এর নিচে মতামত অংশে জনৈক Andy’র একটি মন্তব্য পাই এরকম:“ Bengali claimed purportedly victory because of their own political reason at home. They are just being jactitation. Actually they didn't even win what they had asked for. ITOLS awarded 171,832 square kilometres to Myanmar whereas it allocated approximately 111,631 square kilometres of the relevant area to Bangladesh. Bangla may have won their disputed deep sea block 11 but Myanmar will still retain Bangla's drawn up gas-field blocks 18, 22, 23, 27 and 28.” কৌতূহলী পাঠক-পাঠিকাদের জন্য এ সংক্রান্ত দু’টি লিঙ্ক দিচ্ছি এখানে। আপনারা নিজেরাও দেখে নিতে পারেন - http://horizonspeaks.wordpress.com/2011/09/11/bangladesh-vs-myanmar-the-maritime-arbitration/; http://internationallawobserver.eu/2012/03/15/judgment-in-bangladesh-myanmar-maritime-boundary-dispute/.
    এ থেকে জানতে পারছি - বঙ্গোপসাগরের বিরোধপূর্ণ এলাকার ১১১,৬৩১ বর্গকিলোমিটার অংশ বণ্টন করা হয়েছে বাংলাদেশকে, আর ১৭১,৮৩২ কিলোমিটার অংশের মালিকানা মিয়ানমারের বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। গভীর সাগরের ব্লক ১১ নিয়ে বিরোধে বাংলাদেশ জয়ী হয়েছে, কিন্তু দাবিকৃত ১৮, ২২, ২৩, ২৭ ও ২৮ ব্লক পায় নি। ওগুলোর মালিকানা রয়ে গেছে মিয়ানমারেরই। আমার এবং আমার মতো বহুজনের প্রশ্ন, আসল ঘটনা কি এটাই? বিষয়টি পরিস্কার করতে পারেন শুধু বিশেষজ্ঞ ও বিশারদগণ। তাঁরা নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবেন তাঁদের দায়িত্ব পালনে।
    তবে সাগর জয়ের খবর পেয়ে প্রথমে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, এ জয়ের ফল ভোগ করবে কে? বিদেশী তেল-গ্যাস কোমপানি, দেশী ধনিক ব্যবসায়ী ও আমলাচক্রের বেষ্টনী চুঁইয়ে কি কিছু আসতে পারবে জনমানুষের কাছে? সাগর দূরে থাক, আমাদের নিজেদের নদীনালা খালবিল-ই তো জয় করতে পারছি না আমরা। বাঁধ ও বণ্টনের মধ্যে আমরা হারিয়েছি গঙ্গা নদীকে। তাই পদ্মা আজ পরাজিত। এক শ’ বছর আগে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২) তাঁর ‘কুহু ও কেকা’ (১৯১১) কাব্যে ‘পদ্মার প্রতি’ নামে যে কবিতাটি লিখেছিলেন তা আজ অবিশ্বাস্য, হয়তো হাস্যকরও, মনে হবে এ প্রজন্মের অনেকের কাছে। তিনি লিখেছিলেন -
    “হে পদ্মা! প্রলয়ঙ্করী! হে ভীষণা! ভৈরবী সুন্দরী!
    হে প্রগল্‌ভা! হে প্রবলা! সমুদ্রের যোগ্য সহচরী
    তুমি শুধু; নিবিড় আগ্রহ তার পার গো সহিতে
    একা তুমি; সাগরের প্রিয়তমা অয়ি দুর্বিনীতে!
    দিগন্ত-বিস্তৃত তব হাস্যের কল্লোল তারি মত
    চলিয়াছে তরঙ্গিয়া, - চিরদৃপ্ত, চির-অব্যাহত।
    দুর্দমিত, অসংযত, গূঢ়চারী, গহন-গম্ভীর,
    সীমাহীন অবজ্ঞায় ভাঙিয়া চলেছ উভতীর!...”
    তিস্তা ও ফেনী নদী নিয়ে চলেছে এক অনিশ্চিত প্রক্রিয়া। ওদিকে টিপাইমুখে বাঁধ হুমকি হয়ে উঠেছে সুরমা ও কুশিয়ারা’র জন্য। বাঁধ নির্মিত হতে যাচ্ছে মেঘালয়ে। সবার উপরে ৩৮টি নদ-নদীর মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে এবং ছোট-বড় ৩৪টি বাঁধ ও ৭৮টি বড় জলাধার নির্মাণের মাধ্যমে প্রতিবেশী ভারত যে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নিয়েছে তাতে কোন সর্বনাশ নেমে আসবে আমাদের ওপর তা কি জানি এখনও? অভিজ্ঞ মহল বলছেন, এতে এ দেশের নদী-ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটবে, মরুকরণ শুরু হবে ব্যাপক মাত্রায়, সুন্দরবন ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে, প্রতিবেশগত ভারসাম্যহীনতা দেখা দেবে চরম আকারে।
    এ তো প্রতিবেশীদের ব্যাপারস্যাপার। দেশের ভেতরকার নদ-নদীর অবস্থা কি? রাজধানীর ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর অবস্থা কি? ঢাকার ভেতরকার খাল-নালাগুলো এখন কোথায়? আশপাশের জলাভূমিগুলো কোথায়? দু’ বছরেরও আগে, ২০০৯ সালের ৮ই এপ্রিল, পরিবেশন দূষণ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে যা উল্লেখ করা হয়েছিল এখনও তা সত্য হয়ে আছে হুবহু। এই দু’ বছরে সরকার অনেক কিছু করেছে, আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে ভূমিকাও রেখেছে ? কিন্তু উন্নতি হয়েছে কতখানি কি? প্রতিবেদনটি এ রকম:“The government over the years has allowed industrialists to pollute the rivers, canals and wetlands in and around the city  to such an extent that surface water turned pitch black in several spots. Pollution has set in on the Buriganga, Shitalakhya and Balu rivers and made it almost impossible to treat the water. The water and Sewerage Authority  (wasa), is supplying stinky water by purifying it with cholorine ammonia sulfate. But most of the industrialists have defeid the directive and the government also did not take action against any of the violators. Even the Department of Environment (DoE) does not know much about it. Besides industry generated liquid and solid waste, most of the human excreta directly goes down the rivers through underground pipelines as nearly 70 percent houses are not connected to the excrete treatment plant. Waste from these industries is connected with the sewerage system that directly goes into tha rivers around the city. In fact, the rivers have become a dumping ground of all kinds of solid, liquid, and chemical waste of bank side population.”
    আমরা সাগর জয় করেছি, কিন্তু এই সব ছোট-ছোট জলা-নালার কাছে হেরে বসে আছি কেন? যখন একের পর এক নদী মরছে, খাল-বিল ভরাট হয়ে যাচ্ছে, আর আমরা কিচ্ছু করতে না পেরে কেবল তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছি, তখন উৎসাহ পাই না কোনও সাগরজয়ের উৎসবে। কেউ কি পান?

sazzadqadir@gmail.com; sazzadqadir@rediffmail.com; sazzadqadir@yahoo.com; facebook.com/sazpa85

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন