বৃহস্পতিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১২

বলের বল বাহুবল

হরতাল আমি অপছন্দ করি। আরও অপছন্দ করি জ্বালাও পোড়াও ভাঙচুর। দেশের সম্পদ বিনষ্ট করা, জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি করা সমর্থন করি না মোটেও। যারা অতিউৎসাহে এসব কর্মকা-ে মাতে বা তৎপরতায় লিপ্ত হয় তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলায় কোনও দোষ দেখি না আমি। পরাধীন দেশের সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আর স্বাধীন দেশের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন একই রকম হতে পারে না বলে বিশ্বাস করি। কিন্তু তাহলে সরকারের অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে কিভাবে প্রতিবাদ-আন্দোলন গড়ে তুলবে বিরোধী দল, কিভাবে লড়বে সরকারি দমন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে। ছোটবেলায়, সেই পঞ্চাশ-ষাট দশকে, দেখেছি - দেশে নিত্যপণ্য আক্রা হলে, খাদ্যাভাব দেখা দিলে ভুখ মিছিল বের করতো বিরোধী দল। এতে লজ্জা পেয়ে সরকার তাড়াতাড়ি খুলতো লঙ্গরখানা। না খুললে সরকারকে আরও লজ্জা দিতে বিরোধী দলের পক্ষ থেকেই খোলা হতো লঙ্গরখানা। এখন তো লজ্জা-শরমের বালাই নেই কারও। ভুখ মিছিল তো দূরে থাক ভুখ হরতাল করলেও টনক নড়ে না সরকারের। সেকালে মাইকিং, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, ব্যানার, পোসটার, ফেসটুন, দেয়াল লিখন, চিকা দেখলেই অস্থির হয়ে পড়তো প্রশাসন। এগুলো বন্ধ করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে শুরু করে দিতো ধরপাকড়। তারপর পত্রিকায় বিবৃতি, বিজ্ঞপ্তি দেখলে তো পত্রিকা ভরে যেতো প্রেসনোটে। সভা, সমাবেশ বন্ধ করতে ১৪৪ ধারা দিলেই চলতো তখন। এই আশির দশকেও এরশাদ লাগাতার কারফিউ দিয়ে রাখতেন। আর মিছিল? ভুখ মিছিলের কথা তো বলেছি, এছাড়া মশাল মিছিল ছিল তখন বিরোধী দলের বিশেষ প্রিয় কর্মসূচি। এখন তো লাঠি মিছিল, কাফনের কাপড় পরে মিছিল চলছে হরহামেশা। এ সবে ভ্রুক্ষেপ করে না সরকার। হরতাল, ধর্মঘট তো ধার হারিয়েছে কবে! অনশন ধর্মঘট ভারতে কাজে লাগলেও আমাদের এখানে অচল। শহিদ মিনারে শিক্ষকদের বা প্রেস ক্লাবের সামনে আয়াদের লাগাতার অনশন ধর্মঘট কোনও কাজ দিয়েছে বলে মনে হয় না। অবস্থান ধর্মঘট মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফরিকা, লাতিন আমেরিকায় ক্ষমতায় পালাবদল আনলেও এখানে সুযোগ পর্যন্ত মেলে না অবস্থানের। আর এখন যে ইউরোপ-আমেরিকায় দখল আন্দোলন (অকুপাই মুভমেন্ট) চলছে তা এখানে চালু করা অসম্ভব বললেই হয়। অথচ ষাটের দশকে ঘেরাও ছিল এক কার্যকর কর্মসূচি। মানববন্ধন, পদযাত্রা, সড়কযাত্রা, ট্রেনযাত্রা, শোভাযাত্রা, শোডাউন - এগুলো নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করলেও কোনও পাত্তা দেয় না সরকার। তাহলে কি করবে বিরোধী দল? সরকারি দলের লোকজন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে মহড়া দিলেও সে সব দেখার কেউ নেই। তারা হামলা হানাহানি করলে বরং বাহবা মেলে সরকারি মহলের। এমন পরিস্থিতিতে বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি কোনও বোধোদয় ঘটায় না সরকারের, বরং তামাশার ব্যাপার বলেই ঠেকে সকলের কাছে। সেই কবে ‘পথের দাবী’ (১৯২৬) উপন্যাসে শরৎচন্দ্র লিখেছেন, “ধর্মঘট বলে একটা বস্তু আছে, কিন্তু নিরুপদ্রব ধর্মঘট বলে কোথাও কিছু নেই। সংসারে কোনও ধর্মঘটই কখনও সফল হয় না, যতক্ষণ না পিছনে তার বাহুবল থাকে। শেষ পরীক্ষা তাকেই দিতে হয়।” যে দেশে সদ্যবিদায়ী সরকারি দলকে আচ্ছামতো ছ্যাচা না দিলে নির্বাচনে জয় নিশ্চিত করা যায় না সেখানে বলের বল বাহুবলই তো হয়ে থাকবে!
sazzadqadir@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন