বুধবার, ১১ এপ্রিল, ২০১২

সাযযাদ কাদিরের কবিতায় দেশবোধ

সালমান ফরিদ
কালের সীমানা ছাড়িয়ে কবিতা হয় না। কবিতার জন্য প্রয়োজন সময়, মাটি, মানুষ ও প্রকৃতি। এগুলোর ভেতরেই তামাম কবিতার উপকরণ। বিশ্বসভার কবিদের কাব্যে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোড়িত তা হলো ? সময় ও মানুষ। আর এগুলোর সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে অন্যান্য উপকরণ। এসেছে মাটির কথা। এসেছে প্রকৃতির কথা। অতিপ্রাকৃতিক বিষয়ও ঢুকেছে এখানে। তখন কারও-কারও কবিতায় দেখা গেছে ঐশ্বরিক প্রবণতা। এটা বিশেষ যত্ন পেয়েছে নানা কারণে। যত্ন পেয়েছে দেশবোধও। অবশ্য দেশমাতৃকাকে নিয়ে সব দেশে সমান ভাবে কবিতাচর্চা হয়নি। এটি নিদের্শিত হয়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশগত কারণে। বাংলা কবিতায় যেভাবে দেশ ও প্রকৃতির কথা এসেছে সেভাবে ইংরেজি, আরবি, গ্রিক কিংবা অন্য অনেক ভাষার কবিতায় দেখা যায় নি। কারণ চার ঋতু, মরুর প্রকৃতি আর এখানকার পরিবেশ আলাদা করে দিয়েছে ভাবনা ও উপকরণকে। এই আঙ্গিকটা নির্ণীত হয়েছে মূলত আবহাওয়া ও পরিবেশের কারণে। যে জন্য আমাদের বাংলা কবিতায় যতটা আছে মাটি, গাছপালা, লতাপাতা, পানি, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, বর্ষা, শীত প্রভৃতি, আরবি বা অন্যান্য কবিতায় ততটাই আছে অদৃশ্য সত্তার উপকরণ। আছে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার প্রবণতা সেই সত্তায়। আছে দেব-দেবী। তথা নিয়তিবাদ। সাহিত্যের সব শাখায়ই এর ছাপ বিদ্যমান। কেবল ব্যতিক্রম বাংলা কবিতা। এখানে মিশ্রণ হয়েছে সবগুলো দৃশ্যপটের। এটি অবশ্য প্রাচীন যুগ কিংবা মধ্য যুগ থেকে পুরোপুরি ভাবে নয়। মধ্যযুগে কিঞ্চিৎ দেখা গেলেও প্রয়োগ হয়েছে বেশি আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক যুগে এসে। বাংলা কবিতাকে বেশি আলোড়িত করার কারণ দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে লেগে থাকা নানাবিধ আন্দোলন। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, নব্বই’র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন কবিতাকে করেছে মানুষ, মাটি ও সময়ের সঙ্গে আরও একীভূত। এর আগে দীর্ঘ দু’ শ’ বছর ইংরেজ শাসনে ক্রমে-ক্রমে কবিতা ও সাহিত্যের অন্যান্য সৌন্দর্যে গভীর ভাবে আকৃষ্ট হয়েছে দেশবোধ। এগুলো বাংলা কবিতাকে করেছে স্বতন্ত্র এবং আলাদা ভাবে মর্যাদাবান। এই স্বতন্ত্রেরই একটি ব্যক্তিমানস সাযযাদ কাদির। বাংলা কবিতাকে তিনি আলোকিত করছেন মেধা ও শব্দশিল্পের জোরে। তাঁর কবিতায় প্রজ্ঞার ছাপ স্পষ্ট। সহজ কথায় তিনি বলেন। সরল ভাবে দেখান পথ। ফলে তার বর্ণনা রসবোধে আপ্লুত হয়ে ওঠে। শব্দে-শব্দে হৃদয়নিংড়ানো ভালবাসা। আছে স্বপ্ন ও বাস্তবতা। কখনও অর্জন করেন। কখনও করেন না। যখন করেন তখন টিকিয়ে রাখার মন্ত্র খোঁজেন। আর বঞ্চিত হন যখন, তখন না পাওয়ার যন্ত্রণায় ব্যথিত হন। তার কবিতায় দেশ ও মানবতাবোধ প্রবল। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ আর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তাঁকে প্রভাবিত করেছে ভীষণ ভাবে। তাই তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে নিজেই একটি আন্দোলন। কবিতায় আয়োজন করেছেন মিছিল-সমাবেশের। জাগিয়ে দিয়েছেন আরেকটি স্বপ্নে ?  করেছেন প্রতিবাদমুখর নীরব এ কাশবনকে।
তখন দেখবে রাজপথে-রাজপথে মিছিল
শুনবে মিছিলে-মিছিলে আকাশ কাঁপানো স্লোগান।
দেখবে সভায়-সভায় শপথ, পথে-পথে মোকাবেলা
তারপর তুমি আর কখনও আপস শিখবে না, ভাঙবে না
(‘উত্তরাধিকার’)
এসবই হয়েছে তাঁর উত্তরাধিকার তত্ত্বে। ইতিহাসকে আশ্রয় করে তিনি বলেছেন। ভাষার ভেতর নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশ। প্রেরণা হয়ে উঠেছে বিদ্রোহ আর বিপ্লবের। যে বিপ্লবের কথা শোনা হয়েছে জাতীয় কবির মুখ থেকে। রুখে দাঁড়ানোর অঙ্গীকারে কবি একেবারেই নির্ভেজাল।
অবশ্য এই প্রতিবাদী হয়ে ওঠার পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। ক্ষোভ আছে ভেতরে। যা তাঁকে তাড়িয়েছে সত্য ও সুন্দরের জন্য। ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্য। কতিপয়দের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ তাঁর এ ক্ষোভ বাড়িয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা কঠিন কিংবা তার স্বাদ না পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁকে আরেকবার প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধ করেছে-
তারপর ওই হাতে কি তুমি পরাজয় লিখবে?
(‘উত্তরাধিকার’)
কবির এই সন্দেহটাই যেন বাস্তবতায় শুদ্ধ। সাযযাদ কাদির কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন সাম্প্রতিক ইতিহাসকে। ঐতিহ্যের আশ্রয়ে তিনি পিপাসা মিটিয়েছেন। আবার ইতিহাস বিকৃতির অলীক সত্যকেও জানিয়েছেন বাস্তবিক ব্যাকরণে। উচ্চারণ করেছেন, রাজনীতিকের হাতে ইতিহাসের ‘ইচ্ছা পূরণের শৌখিন বিলাসিতায় পরিণত হওয়াকে’। ইতিহাস নিয়ে তাদের মর্জিটাও বিস্তর প্রাধান্য পেয়েছে। আর সত্যিকার অর্থে এটাই দেখছে এ প্রজন্মের নাগরিকেরা।
তিনি কবিতায় শব্দ ও ভাষার প্রয়োগে বরাবরই নিজস্ব। অত্যন্ত সহজ সরল ভাবে কথামালাকে কবিতা বানিয়ে পাঠকের মুখে-মুখে পৌঁছে দেয়ায় পরীক্ষিত সফলতা পেয়েছেন। আর যে ভাষায় তিনি এভাবে পাঠকের কাছে স্বতন্ত্র কবিসত্তায় পরিণত হয়েছেন সেই ভাষাকে বিলিয়ে দিয়েছেন সর্বত্র। আটকে রাখেন নি পাঠশালার বইয়ে অথবা বায়ান্ন’র ঐতিহাসিক কোঠায়। ছড়িয়েছেন এখানে-ওখানে ?
তুমি আমার শহিদ মিনার,
আমার বাংলা বিভাগ, আমার দৈনিক বাংলা,
আমার মুনীর অপটিমা, আমার বিজয়লিপি
আমার বইমেলা, আমার বৈশাখি মেলা
তুমি আমার বাংলা,
তোমাকে আমি ভালবাসি।
(‘বাংলাভাষা, তুমি’)
একই ভাবে বইয়ের পুঁথিগত অধ্যায়েও সীমাবদ্ধ রাখেন নি। ‘যারা কম্পিউটার, ইন্টারনেট ইত্যাদির পরিভাষা খুঁজে হদ্দ হয়’ তাদের কাছেও বাংলা ভাষাকে তুলে দিয়েছেন। এদের কাছে ছড়িয়ে দিয়ে হতাশও হয়েছেন এক অর্থে। ভাষায় সঠিক প্রয়োগের অভাবে চারদিকে ভাষা নিয়ে অবক্ষয় চলছে। বানান নিয়ে চলছে আরেক তুলকালাম কাণ্ড।  ভুল বানান লিখেও নিজের দোষ আড়াল করেন কেউ-কেউ। এ নিয়ে রসিকতা করেছেন বিস্তর। তিনি তাদের জবাবটা দিয়েছেন তাদের মুখেই ? ‘আমি ওই রকমই লিখি’ বলে।
দেশকে তিনি কবিতার সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ কবিতায় যেভাবে ফুটে উঠেছে তাতে তার বৈশিষ্ট নির্ণীত হয়েছে পরিবেশের আবর্তে। যা বলেছি শুরুতেই। সাযযাদ কাদির তাঁর কবিতায় সেই কথাটিই প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলার রূপ উঠে এসেছে কবিতার ভাঁজে-ভাঁজে। সৌন্দর্য আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়েছে কবিতার কল্যাণে। লাবণ্য পেয়েছে ভাষার মাধুর্যে। কিন্তু কিভাবে এটা সম্ভব হলো? তাঁর উপকরণ একেবারে তিলোত্তমা অপরূপা বাংলার কোনও না কোনও প্রান্তে থাকা প্রজ্ঞাবান সত্তার মস্তিষ্কজাত! ফলে সৌন্দর্যের মাঝে কবিতা আর বাংলাদেশ একাকার হয়ে গেছে। বাংলার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে বাংলা কবিতা। কবি সে কথাটাই বলেছেন এভাবে ?
বাংলা কবিতা এই বাংলার মতোই
(‘বাংলা কবিতা’)
তাঁর কবিতায় অপরূপ রমণী থেকে শুরু করে রাখাল বালকের কথা মেলে। মেলে কৃষক-শ্রমিকের কথা। আছে সুন্দরীর খোঁপায় ফুলের মালা গুঁজে দেয়ার দৃশ্যও। আকুল-ব্যাকুল হওয়া বাঁশির শব্দ বেজে ওঠে বারবার। আছে সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ। বাবার কথা। বলেছেন একাত্তরে সন্তান হারিয়ে কিভাবে বুক চাপড়ে মা মর্সিয়া করেছে। সেই মা, সেই বাবা, সেই বোন, সেই ভাই ? তাদের কান্নার সঙ্গে কেঁদেছে এই বাংলার নদী। সে-ও মূর্ছা গেছে পরিজনের মতো করে। সংজ্ঞাহীন হয়েছে বাংলার প্রতিটি গ্রাম-প্রান্তর। এই বাণী পৌঁছে দিয়েছেন নতুন প্রজন্মের কাছে।
তাঁর কবিতার শব্দগুচ্ছে আছে বিদ্রোহ। যে বিদ্রোহ বাংলা কবিতাকে করেছে মহিমান্বিত। এখন যে প্রতিবাদ করে কিছু হয় না তা বলেছেন। কি করতে হবে তাহলে? সঙ্গে-সঙ্গে দিয়েছেন সেই সমাধানও। বলেছেন, করতে হবে আঘাত। কাপুরুষের মতো বসে না থেকে অল্প শক্তি দিয়ে আঘাত করার মাঝে তিনি বীরত্বের সন্ধান দিয়েছেন। এক্ষেত্রে উদাহরণ হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার ইরাক, আফগানিস্তান আক্রমণের বিষয়টি। সেখানে অল্পশক্তির প্রতিরোধ তাকে শক্তি যুগিয়েছে। ‘আমি প্রতিবাদ করি না/আঘাত করি।’ তার এই ‘আমি’ হলো তামাম পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষ। যারা এখন প্রতিবাদ করা ভুলে রুখে দাঁড়াচ্ছে। মৃত্যুর সারি বাড়িয়ে তারা আঘাত করছে বিশ্ববিবেক ও সভ্যতায়। ইতিহাসের বুকে আঘাত করে প্রতীকী ‘আমি’ হয়েছেন কবি। এর মাধ্যমে মাথা নত না করার অঙ্গীকার জানিয়েছেন। আর বাংলাদেশের জন্য তিনি প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে বেছে নিয়েছেন কবিতাকে ?
বিদেশী ঠাকুর মানে না, ভিখারি রাঘবে ডরায় না।
যারা নিভিয়ে দেয় আলো, বিষিয়ে দেয় বায়ু
তাদের ক্ষমা করে না বাংলা কবিতা
(‘বাংলা কবিতা’)
কবি মুক্তিযুদ্ধ থেকে উপকরণ নিয়েছেন তাঁর কবিতার। শব্দের শিল্প মার্জিত করেছেন মাটির ভালবাসা ছুঁইয়ে। সর্বত্রই মাটি ও মানুষের ছায়া। বাংলাদেশ নামের এক খণ্ড ভূমির মালিকানা পেতে একাত্তরের জন্ম। আর সেই একাত্তর এখন মিশে আছে এই মাটির গন্ধে। পরতে-পরতে লেগে আছে তার ছোঁয়া। সেটিই প্রকাশ করেন কবিতায় ?
যেখানে পাতবে কান
শুনবে সেখানে
অবিনাশী তানে
একাত্তরের গান।
(‘একাত্তরের গান’)
স্বকীয় কবি সত্তায় সাযযাদ কাদিরকে আবিষ্কার করেন বিদগ্ধজনেরা। লিখেন তিনি সম্পূর্ণ আলাদা মেজাজ ও ভঙ্গিতে। নতুন রীতি মনে না হলেও অনেকটা নতুন করেই বলা হয়। পাঠকরা তাই সহজে তার কবিতা আলাদা করতে পারেন এই স্বকীয়তার গুণে। দেশাত্মবোধক কবিতার ক্ষেত্রেও এটির যথাযথ প্রতিফলন দেখিয়েছেন। আবার সমকালীন কবিতাকে যে একেবারে এড়িয়ে গেছেন, তা-ও কিন্তু নয়। বাংলা ভাষার আকার ও সৌবর্ণ খুঁজতে গিয়ে শামসুর রাহমানের ঐতিহ্য মেনেছেন। তাঁর মতো করে একেবারে সহজ ভাবে বাংলা ভাষার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ?
বাংলা ভাষা
তুমি হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতা
তুমি আলতাফ মাহমুদের গান
তুমি জহির রায়হানের কথাছবি
(‘বাংলাভাষা, তুমি’)
এই মুহূর্তে বাংলা সাহিত্যে শীর্ষ কবিদের একজন সাযযাদ কাদির। পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠা এই কবির গুণই হচ্ছে প্রাণবন্ত করে বলার দক্ষতা ও ক্ষমতা। আর শব্দের সহজ সরলতা। প্রেম-রোমান্স, মানবিক সৌন্দর্য আর জীবনঘনিষ্ঠতা সব দিকই সমান ভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। জীবনানন্দ দাশ যেখানে বনলতা সেনের চুল আর শ্রাবস্তীর কারুকাজে কিংবা বিদর্ভ নগরীতে খুঁজেছেন তাঁর সুখ ? সাযযাদ কাদির এখানে হয়েছেন একেবারেই আলাদা। চণ্ডীদাস থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, উইলিয়াম কেরি থেকে হ্যারি কে টমাস, লি ইউয়ানশানের কাছে ভবিষ্যতের জন্য ভালবাসা খুঁজেছেন। এ ভালবাসা দেশমাতৃকার জন্য। প্রেম-ভালবাসা সিক্ত হয়েছে এই সব কবিতার একেকটি লাইনে। মানব মনের অব্যক্ত কথা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রেমের কবিতায়। আর দেশাত্মবোধক কবিতায় মুগ্ধ হয়েছেন নিখুঁত দেশপ্রেমে।

সালমান ফরিদ: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন