রবিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১২

সাযযাদ কাদির: ৬৫তম জন্মদিনে বিশেষ সাক্ষাৎকার

কবি সাযযাদ কাদির বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এক বহুদর্শী ব্যক্তিত্ব। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় তাঁর সৃষ্টিশীল বিচরণ বিস্ময় জাগায় পাঠকদের। শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, সম্পাদনার কারণেও খ্যাতিমান তিনি।  সম্পাদনা প্রতিভা তাঁর অনন্য, রয়েছে সাংগঠনিক দক্ষতা। নিশ্ছিদ্র গভীর জ্ঞানের অনুসন্ধানে তিনি ব্রতী ও মনস্ক। ১৪ই এপ্রিল ১৯৪৭ সালে তাঁর জন্ম মাতুলালয় টাঙ্গাইল জেলা-শহরের উপকণ্ঠ-গ্রাম মিরের বেতকায়। পিত্রালয় একই জেলার দেলদুয়ার উপজেলা-সদরে। ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স ও এম এ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যথেচ্ছ ধ্রুপদ’ প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে, গল্পগ্রন্থ ‘চন্দনে মৃগপদচিহ্ন’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। কবিতা ও গল্প ছাড়াও উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ-গবেষণা, শিশুতোষ, সম্পাদনা, সঙ্কলন, অনুবাদ সহ বিভিন্ন বিষয়ে ৬০টির বেশি গ্রন্থের প্রণেতা সাযযাদ কাদিরের একাদশ কবিতাগ্রন্থ “বৃষ্টিবিলীন” প্রকাশিত হয়েছে গত অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। সাহিত্য সংস্কৃতি, সমকালীন প্রসঙ্গ সহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন ‘আমার দেশ’ সাহিত্য সাময়িকীর প্রতিনিধি কবি হাসান হাফিজ। কবি সাযযাদ কাদিরের ৬৫তম জন্মদিন উপলক্ষে সে আলোচনার উল্লেখযোগ্য অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো এখানে:

লেখালেখিতে কেমন করে এলেন?
ছোটবেলায় পড়তে শেখার পর শিখেছি লিখতে। পড়তে-পড়তে হয়েছিল পড়ার নেশা। আর লিখতে-লিখতে হয়েছে লেখালেখির নেশা। এ নেশা ফোর-ফাইভে পড়ার সময় থেকে। তখনই উৎসাহ-অনুপ্রেরণা পেয়েছি অনেকের কাছ থেকে। তাতে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে ক্রমে। একটু বড় হয়ে, মানে ক্লাশ এইটে পড়ার সময় থেকে, ঢাকার পত্রপত্রিকার শিশুকিশোর বিভাগে লেখা পাঠাতে থাকি। পদ্য, ছড়া, গল্প - এসব। পাঠিয়েছি, কিন্তু ভাবি নি তখনকার টাঙ্গাইলের মতো এক ঘোরতর মফস্বুলে গ্রাম-শহর থেকে পাঠানো এক বালকের লেখা ছাপার অক্ষরে প্রকাশ পাবে কোনও দিন। কিন্তু আমাকে ও আমার চেনাজানা সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে সব লেখা ছাপা হয়েছে ঠিকই। তবে শিশুতোষ লেখা লিখি নি বেশি দিন। ১৯৬২ সালে কলেজে ভর্তি হই অর্থাৎ সাবালক হয়ে উঠি। তখন ‘সাবালক’ কবিতা ও গল্প পাঠাতে থাকি পত্রপত্রিকায়। সেগুলো ছাপাও হতে থাকে। ফলে ওই সময় থেকেই আমি পরিচিত হয়ে উঠি লেখালেখির জগতে। তারপর এই ৫০ বছর ধরে আছি লেখার নেশাতেই। সেই সঙ্গে সেই পড়ার নেশা তো আছেই। আরও আছে দু’টি ঘোর নেশা - গান শোনা আর ছবি দেখা।
কবিতা ও গদ্য - কোন ধরনের রচনায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন? কেন?
লেখালেখির শুরু থেকেই চর্চা করে আসছি দু’টোরই। দীর্ঘ দিনের চর্চায় তো এক ধরনের অভ্যস্ততা, স্বাচ্ছন্দ্য তৈরি হয়ে যায়ই। সে স্বাচ্ছন্দ্য আছে আমার। তাছাড়া সব লেখাই আমি লিখি আগাগোড়া ভেবেচিন্তে। কোনও লেখার ভাবনা মাথায় এলে তা কোত্থেকে শুরু করে, কি-কি লিখে, কোথায় শেষ করবো - তা মনে-মনে ছকে নিই আগে। তারপর লিখতে বসি।
বলা হয়, বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ রাজধানী হবে ঢাকা। অনেকের মতে, এই লক্ষণ ক্রমেই পরিস্ফুট হয়ে উঠছে। আপনার কি অভিমত?
এ রকম কথা বলা হচ্ছে সেই পঞ্চাশ-ষাট দশক থেকে। বায়ান্ন’র লড়াইয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে আমরা সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছি চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে। সে লড়াইয়ের রক্তঝরা পথ বেয়েই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ - আমাদের স্বাধীনতা। আমরা ভেবেছি, এই অর্জন আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে সর্বক্ষেত্রে। কিন্তু তা হয় নি। রাজনীতি দুর্নীতিগ্রস্ত, অর্থনীতি ভঙ্গুর, সমাজ কলুষিত। চল্লিশ বছর পরও অবক্ষয় সর্বত্র। সমাজপ্রগতি স্তব্ধ। এ অবস্থায় বিচ্ছিন্ন ভাবে কোনও মাধ্যম কি শীর্ষ সাফল্য পেতে পারে? চলচ্চিত্র, নাটক, টেলিভিশন, বেতার, সংগীত, চিত্রকলা, ক্রীড়া - কি অবস্থায় আছে? আমরা নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি করতে চাই কিন্তু চারপাশে অনেক বাধা। ওদিকে কলকাতা চাইছে তাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে। ষাটের দশকে আমরা যেভাবে উরদুত্বকে মোকাবিলা করে বাংলাকে উঁচুতে রাখার সংগ্রাম করেছি, ওঁরা সেভাবেই হিন্দিত্বকে মোকাবিলা করে চলেছে, আর চ্যালেঞ্জ হিসেবে নতুন-নতুন ধারায় সৃষ্টিশীলতাকে অব্যাহত রাখছে। ওঁরা সমর্থন ও সাহস পাচ্ছে ওঁদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিবেশ থেকে, কিন্তু এমন সমর্থন ও স্বাধীনতা এখানে কোথায়? এখানে বিভাজন, পরমতঅসহিষ্ণুতা, চরিত্রহনন ব্যাপক। দলীয়করণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মেধা, শ্রম, সততা আর যোগ্যতা বলে বিবেচিত হয় না; তাই সর্বোচ্চ শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানে চাকরি হয়ে যায় গাড়লদের, এবং তারা দিব্যি ছড়ি ঘুরিয়ে বেড়ায়। যেখানে কবিরা রাজকবি হয়ে ওঠে বা রাজকবি হতে চায় ্ল- সেখানে সাহিত্যের ভবিষ্যৎ কি? কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা যখন ভিন্নমত পোষণের ও সমালোচনা করার অধিকার বিসর্জন দেয়, তখন দেশ জাতি জনগণের জন্য আর কিছু থাকে না তাদের। দেশ, রাজধানী - এ সব তো মানুষের। সেই মানুষের পক্ষে না থেকে যারা প্রতিষ্ঠার পোঁ ধরে তারা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে কোন গতিধারা আনবে? তবুও অবিশ্বাসী নই আমি। হতাশ নই। এই বৈরী সময়কে, অবক্ষয়কে চ্যালেঞ্জ করে সৃষ্টিশক্তির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটবেই এখানে। বিশাল বাংলা আজ কাঁটাতারের বেড়ায় ছিন্নভিন্ন, কিন্তু আমাদের মানসবাংলা অভিন্ন আকাশের নিচে হাজার বছরের এক পবিত্র ঐতিহ্যভূমি। এর ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্যকে কখনওই বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন করতে পারবে না কোনও রাষ্ট্রনীতি, কোনও কূটকচাল। তাই ঢাকা শুধু সাহিত্যের নয়, প্রতিটি বাঙালির মনে চিরজাগরূক সে বিশাল মানসবাংলা, তার রাজধানী হবে একদিন।
তারুণ্যের স্পর্ধিত বিকাশে লিটল ম্যাগাজিনগুলো আজকাল ঈপ্সিত ভূমিকা পালন করতে পারছে না বলে কারও-কারও ধারণা। এ ব্যাপারে আপনার পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে বলুন।
ষাটের দশকের লিটল ম্যাগাজিন চর্চায় আমি যুক্ত ছিলাম। আমার ভূমিকাও ছিল উল্লেখ করার মতো। ‘স্বাক্ষর’, ‘কণ্ঠস্বর’, ‘ছোটগল্প’ ও আরও অনেক ম্যাগাজিনে লিখেছি, কাজ করেছি। নিজে সম্পাদনা, প্রকাশনা করেছি। এগুলো ‘লিটল’ কেন তা বুঝি না। চালু হওয়া নাম ছাড়া আর কি? এগুলো সবই সাহিত্য পত্রিকা। সাহিত্যপত্র, কবিতাপত্র বা এ রকম কিছু। চালু বহু কিছু ঝেড়ে ফেললেও এই ‘চালু’ কথাটা যে কেন ঝাড়া গেল না এত দিনে তা বুঝি না। লিটল ম্যাগাজিনে লিখে আমি স্বস্তি পাই। তখনও পেয়েছি, এখনও পাই। আমি খুঁজে-খুঁজে সবচেয়ে বেশি কিনি ও পড়ি লিটল ম্যাগাজিন। আমার দরকারি বহু সম্পদ-সামগ্রী পাই এখানে। হারিয়ে যাওয়া, ভুলে যাওয়া কত কি পেয়ে যাই! তাছাড়া নতুন রকম লেখা, নতুন ভাবে দেখা থাকে লিটল ম্যাগাজিনে। যখন দেখি চালুর ব্যাপারে দ্রোহ, আক্রমণ তখন বেশি ভাল লাগে। তবে সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়ার যে ধান্দাবাজি চলছে তা আরও খুলে দেখাতে পারতো তারা। প্রতিষ্ঠার প্রতিভূদের নানা মতলববাজি, অলেখকদের দৌরাত্ম্য, ভুয়াদের গ্রুপিং - এগুলো ন্যাংটো করে দেয়া দরকার। এ সব করতে গেলে অবশ্য নিজের ক্ষতি স্বীকারে প্রস্তুত থাকার সাহস থাকতে হবে।
সাহিত্যে গোষ্ঠীবদ্ধতা কতটা প্রয়োজন? সেটা কি ক্ষতিকর, না উপকারী? আপনার কি মনে হয়?
সাহিত্য আর যা-ই হোক দল বেঁধে, গোষ্ঠী গড়ে করা যায় না। কিন্তু প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠায় গোষ্ঠীবদ্ধতা ভূমিকা রাখে। এখন তো গোষ্ঠী-গ্রুপিং ছাড়া লেখা প্রকাশ করাই মুশকিল। মুখে গণতন্ত্রের পক্ষে, দলীয়করণের বিপক্ষে কথা বললেও বহু প্রকাশ-প্রচার মাধ্যমে কড়া দলবাজি চলছে। রীতিমতো কালো তালিকা তৈরি করে এক ধরনের ফাসিস্ত ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর। মুখ চিনে লেখা বা বই ছাপা হয়, অনুষ্ঠানে ডাকা হয়। এই গোষ্ঠী-গ্রুপিং অসুস্থ, অস্বাস্থ্যকর। এর মধ্যে সৃষ্টির চেয়ে বেশি আছে হননেচ্ছা। আমার নিজের অভিজ্ঞতা আছে এ ব্যাপারে। এক সাহিত্য সাময়িকীতে আমার লেখা ছাপা হয় না - আমি গাঞ্জুটি বা হেরোইনচি নই বলে। ওই সাময়িকী যিনি প্রযোজনা করেন তিনি নিজে একজন গাঞ্জুটি, তাই একই রকম পালকের পাখিদের সমাদর সেখানে।
কেমন বাংলাদেশ আপনি দেখতে চান?
আমি চেয়েছিলাম বাংলাদেশ হবে সমাজকল্যাণ রাষ্ট্র। সমাজে জীবনে থাকবে উদার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। এই কল্যাণরাষ্ট্র হবে “a concept of government in which the state plays a key role in the protection and promotion of the economic and social well-being of its citizens. It is based on the principles of equality of opportunity, equitable distribution of wealth, and public responsibility for those unable to avail themselves of the minimal provisions for a good life. The general term may cover a variety of forms of economic and social organization.”  মডেল হবে নোরডিক - সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ডের মতো। কিন্তু কি পেয়েছি? সকালে বা বিকালে শাহবাগে যাওয়ার পথে পরীবাগে দেখি ফুটপাতে অসহায় নরনারীশিশুর জীবন। কাওরানবাজারে আমার অফিস। রাতে বাসায় ফেরার পথে ভিআইপি রোডের ফুটপাতেও দেখি সেই দুঃস্থ নরনারীশিশুদের। দেখি প্রখর উজ্জ্বল আলোর নিচে কত নিকষ কালো অন্ধকার। গ্রীন রোডে থাকি। এ রোডেরও এখানে-ওখানে ফুটপাতে দেখি ওই নিঃসহায়দের। এই ভুখানাঙ্গা ছিন্নমূল মানুষকে দেখবো চারপাশে আর শুনবো ক্ষমতার রাজনীতির গলাফাটা চেঁচামেচি? না, এমন দেশ আমি চাই নি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন