শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১২

উপকথার তিন বানর

মানুষ আধা-সুখী আধা-দুঃখী প্রাণী। তাই কখনও কোনও কিছুতে পুরো খুশি হয় না সে। নানা অভিযোগ-অনুযোগ তার থাকেই। এ অসন্তোষ থাকে সকল কালেই। আগেও ছিল, এখনও আছে। সেই হাজার বছর আগে চর্যাপদের কবি ঢেণ্‌ঢণপা আক্ষেপ করেছেন ‘হাড়ীত ভাত নাহি’ (হাঁড়িতে ভাত নেই)। মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম করেছেন ব্যথিত উচ্চারণ ‘শিশু কাঁদে ওদনের (ভাতের) তরে’। আলাওল প্রকাশ করেছেন ক্ষোভ ‘না পাইয়া বিচার পড়িলুঁ কারাগারে’। একালে নজরুল-ও বলেছেন ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ চায় দু’টি ভাত একটু নুন’।
যুগে-যুগে অনেক শাসক এসেছেন, অনেক রকম শাসন-ব্যবস্থা চালু করেছেন, কিন্তু খুশি হয়েছে কি মানুষ? হয় নি। তাই শাসক থাকেন নি, শাসন ব্যবস্থাও থাকে নি। রাজতন্ত্র, পুরোহিততন্ত্র, খিলাফত, প্রজাতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, সংসদীয় গণতন্ত্র, প্রেসিডেন্সিয়াল গণতন্ত্র, বুনিয়াদি গণতন্ত্র, জনগণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, দলতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র - কত রকম তন্ত্র-মন্ত্র নিয়ে কত রকম যোগাড়যন্ত্র কত দেশে চলেছে এবং চলছে - কিন্তু সব মানুষ খুশি হতে পেরেছে কি? আমাদের দেশেও কি পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলো বা হচ্ছে কম? কিন্তু শান্তি-স্বস্তি কি এসেছে কিছু?
তাহলে সমাধান কি? সব মানুষকে খুশি করা যাবে না, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষকে তো খুশি করা সম্ভব। সেটা কোন ব্যবস্থায় সম্ভব? সেই ষাটের দশকের শুরুতে, কলেজে পৌরনীতির পাঠ্যপুস্তকে, পড়েছিলাম সোস্যাল ওয়েলফেয়ার স্টেট অর্থাৎ কল্যাণরাষ্ট্রের কথা। তখন থেকেই ওই রাষ্ট্রচিন্তা গেঁথে আছে মাথায়। এখনও ভাবি অমন এক রাষ্ট্রের কথা। ১৯৮৪ সালে ‘সংবাদ’-এর সম্পাদকীয় বৈঠকে সে কথা বলেছিলাম একদিন। সে বৈঠকে ছিলেন সম্পাদক আহমদুল কবির, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বজলুর রহমান, সহকারী সম্পাদক তোয়াহা খান, সন্তোষ গুপ্ত ও আনিসুর রহমান। প্রথম চারজন আজ আর নেই, শেষে উল্লিখিত জন আছেন সুইডেন-এ। আমার ওই কথায় সেদিন আহমদুল কবির বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের জন্য দরকার একজন বেনেভোলেন্ট ডিকটেটর (উদার একনায়ক)। তাছাড়া উন্নয়ন-কাজ গতি পাবে না।’ এ কথার পক্ষে উদাহরণ সহকারে বেশ কিছু যুক্তি দিয়েছিলেন তিনি, তবুও কেন জানি মেনে নিতে পারি নি একনায়কীয় শাসনের কোন চিন্তাকে। হয়তো তখন দেশে চলছিল একনায়কীয় শাসন - সেটাও হতে পারে এক বিশেষ কারণ। তবে এখনও ভাবি, এ দেশ একদিন হবে গণতান্ত্রিক অধিকার সংবলিত এক কল্যাণরাষ্ট্র। আমার অধিকার থাকবে ভিন্নমত পোষণের, সমালোচনা করার। এখন তো সে অধিকার আক্রান্ত পদে-পদে। ভিন্নমতাবলম্বী হওয়ার অর্থ আপনি হয় ‘রাজাকার’ নয় ‘বাকশাল’। আর সমালোচক হলে আপনি হয় ‘আল-আবদুল’ নয় ‘আল-বদরুদ্দিন’। অথচ লেখক ও সাংবাদিক হিসেবে যত কিছু দেখি শুনি জানি তার এক-শতাংশও তো লিখতে পারি না আমরা। এ এক অদভুত পীড়ন। দেখবো শুনবো জানবো কিন্তু বলতে পারবো না। লিখতে পারবো না। থাকবো উপকথার তিন বানরের মতো দু’হাতে চোখ কান মুখ চেপে রেখে।
সবাই বলেন - ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। আসলে ঘটে উলটোটাই। তাই এত মহান নেতা দেশে-দেশে। কিন্তু আমাদের দেশের জনগণই সকল অর্থে মহান। আর যে দেশের জনগণ মহান সে দেশের কোনও মহান নেতার প্রয়োজন নেই।
sazzadqadir@rediffmail.com 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন