বৃহস্পতিবার, ৮ মার্চ, ২০১২

সত্য শুধু নিজেরটুকু

মাগুরা’য় বাউলদের অনুষ্ঠানে হামলা হয়েছে কিছু দিন আগে। মাদরাসা-মক্তবের ছাত্র-শিক্ষকেরা মিলে পণ্ড করে দিয়েছে তাদের আসর, মারপিটও করেছে। এর আগে বাউলদের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনা ঘটে রাজবাড়িতে। সেখানে তাদের হেনস্তা করা হয় রীতিমতো মাথা মুড়িয়ে। ক’ দিন আগে হিন্দুদের মন্দির-অনুষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর হয় চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে। দাড়ি, টুপি ও বোরকা’র কারণেও লাঞ্ছনা-গঞ্জনার ঘটনা ঘটছে এখানে ওখানে। বলবো, এ সবই সমাজে হিংসা ছড়িয়ে পড়ার ফল। তাই অসহিষ্ণুতা আর উত্তেজনা সবখানে। এ অসহিষ্ণুতার কারণ যে মত, পথ, চিন্তাধারা নিয়ে বিরোধিতা বা দল, গোষ্ঠী, সমপ্রদায়গত ভিন্নতা ? তা নয়। কোনও আর্থ-সামাজিক স্বার্থও ইন্ধন যোগায় এ সবের পিছনে। জায়গা-জমি দখল, আর্থিক লেনদেন ইত্যাদি নিয়েই উত্তেজনা সৃষ্টি হয় বেশি, তবে যথাবিহিত আমন্ত্রণ বা আসন না পাওয়ার কারণেও হুড়হাঙ্গামা ঘটে অনেক। হানাহানির খবর তাই সবখানে সবদিন। এ এক নিত্য সামাজিক উচ্ছৃঙ্খলতা। আজ ৮ই মার্চের পত্রপত্রিকায় পড়ছি এমনই কয়েকটি খবর। রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার মোফাজ্জল হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে অস্ত্র দেখিয়ে অপহরণ করেছিল ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগের তিন কর্মী। তারা লাঞ্ছিতও করছে তাঁকে। বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে তাদের মনোনীত প্রার্থীকে সমর্থন দিতে প্রধান শিক্ষককে বাধ্য করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কাপাসিয়ায় ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীদের হামলায় আহত বিরোধী দলের অঙ্গ সংগঠন যুবদলের কর্মীর মৃত্যু ঘটেছে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় জমিজমা নিয়ে বিরোধের জের ধরে এক গৃহবধূকে পিটিয়ে হত্যা করেছে প্রতিবেশী পক্ষ। মাগুরা’র শ্রীপুরে দুই দল গ্রামবাসীর সংঘর্ষে ভাঙচুর ও লুট হয়েছে ৫০-৬০টি ঘরবাড়ি। এর নেপথ্যে রয়েছে এক চেয়ারম্যান ও এক মেম্বারের নির্বাচনী বিরোধ। জেলায়-জেলায় এমন দলে-দলে চড়াও হওয়ার খবর আছে আরও। প্রশ্ন করি, কেন এত হামলা হাঙ্গামা অস্থির করে তুলছে সমাজজীবনকে? উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই চোখে পড়ে আমাদের আক্রমণাত্মক রাজনীতির চেহারাটা। এ রাজনীতির ভাষায় হিংসার উত্তাপ, বিদ্বেষের বিষ আর শক্তির আস্ফালনই শুধু শুনি। কারণ অন্য কিছু নয় ? ক্ষমতাহীনের ঈর্ষা আর ক্ষমতাসীনের ভয়। এই কাড়াকাড়ি কামড়াকামড়ি কোনও শুভতার লক্ষণ নয়, তবে অত্যন্ত সংক্রামক। তাই ক্ষমতাকেন্দ্রের পথ ও প্রাসাদ থেকে তা ছড়িয়ে পড়ে সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে একটি প্রশ্ন তুলেছেন শরৎচন্দ্র ? ‘মাত্র নিজের প্রয়োজনটুকুই কি একমাত্র সত্য?’ আমাদের রাজনীতিতে এ প্রশ্নের উত্তর, হ্যাঁ। এখানে নিজেরটুকু ছাড়া অন্যের কোনও কিছুর কোনও মূল্য নেই, সেগুলোর মূলোৎপাটনই একমাত্র লক্ষ্য। রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে এখানে সমাপ্তি টানি আমার বক্তব্যে। তিনি লিখেছেন, “কোনও দেশের অধিপতি যদি এ কথা অত্যন্ত করে জানেন যে সেই দেশ থেকে তাঁদের নানাপ্রকার সুবিধা ঘটছে, তবে সেই দেশকে তাঁরা সুবিধার কঠিন জড় আবরণে বেষ্টিত করে দেখেন ? প্রয়োজন সম্বন্ধের অতীত যে চিত্ত তাকে তাঁরা দেখতে পারেন না।” (‘বিশ্বব্যাপী’, “শান্তিনিকেতন”)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন