বৃহস্পতিবার, ২৯ মার্চ, ২০১২

চুপ! গণতন্ত্র চলছে!!

 এটা করবো? না। ওটা করবো? না। তাহলে কেমন করবো? কেমনও করবে না। কি করবো তবে? চুপ করবে। দেশে এখন গণতন্ত্র চলছে। এ গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে সমাবেশ, মিছিল, মানববন্ধন, প্রচার, অনুষ্ঠান ঠেকাতে হবে। স্মৃতিসৌধে যেতে পদে-পদে বাধা দিতে হবে, বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান বাতিল করতে হবে, খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে যাওয়া চলবে না। ইতিহাসবিদরা ইতিহাসচর্চা করতে পারবেন না, রাজনীতিকরা করবেন। সাংবাদিকরা সংবাদ লিখতে পারবেন না, প্রশাসন দেখবে। এমন অনেক কলকাঠি নাড়ার কল আছে সরকারের। সেগুলো ক্রমে-ক্রমে বেশি করে নাড়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠছে দিনে-দিনে। গণতন্ত্রের নামে ? আসলে যে কোনও কিছুর দোহাই দিয়ে, ছুতোনাতা করে বা অজুহাত দেখিয়ে অপছন্দের লোকজনকে কলে ফেলার মতো সহজ কাজ আর কিছু নেই সরকারের। কিন্তু আমি বলি এসব কল তাদের কব্জায় রাখাই ভাল। আমার প্রিয় বিজ্ঞানচেতনাবাদী সাহিত্যিক-চিন্তাবিদ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) সেই কবে ‘কমলাকান্তের দপ্তরে’ (১৮৭৫)-র ‘আমার মন’ নিবন্ধে লিখেছেন, “তোমরা এত কল করিতেছ, মনুষ্যে মনুষ্যে প্রণয় বৃদ্ধির জন্য কি একটা কিছু কল হয় না? একটা বুদ্ধি খাটাইয়া দেখ, নহিলে সকল বেকল হইয়া যাইবে।”
    বঙ্কিমচন্দ্র যখন ওই নিবন্ধ লেখেন তখন ‘মনুষ্যে মনুষ্যে প্রণয় বৃদ্ধি’র আয়োজন চলছিল ইউরোপে ? বিশেষ করে ফ্রান্সে। Denis Saurat: লিখেছেন ? “১৮৭০-এর বিপর্যয়কালে ফ্রান্সে প্রতিষ্ঠিত হয় তৃতীয় প্রজাতন্ত্র... এ প্রজাতন্ত্র স্থান করে নেয় জনমানুষের হৃদয়ে; আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারমূলক কাজ হয়ে ওঠে জনগণের শিক্ষা। ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো ফ্রান্সের প্রতিটি গ্রামে স্থাপিত হয় একটি করে স্কুল; প্রাথমিক হলেও কার্যকর শিক্ষা পায় সাধারণ মানুষ, শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে রাষ্ট্র স্কুল প্রতিষ্ঠা করে সর্বত্র, নিখরচায় লেখাপড়ার সুযোগ দেয় সবাইকে।... বিনামূল্যে শিক্ষা পাওয়ার অধিকারী হয় সবাই; ধর্মের কোনও স্থান থাকে না স্কুলে; সকল নারী ও পুরুষের দায়িত্ব হয়ে পড়ে নিজেদের শিক্ষিত করা। গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত শিক্ষা।” (Modern French Literature, 1870-1940 )
    আমরা যে গণতন্ত্র-গণতন্ত্র করে মরছি সে গণতন্ত্রের জন্য কি করেছি বা করছি আমরা? প্রতিবেশী ভারতের অভিজ্ঞতা এখানে উল্লেখ করা যায় উদাহরণ হিসেবে, প্রখ্যাত গবেষক-চিন্তাবিদ সুভদ্রকুমার সেন লিখেছেন, “ভারতীয় সাধারণ প্রজাতন্ত্রের সংবিধান (২৬শে জানুয়ারি, ১৯৫০) একটি সমস্যা-কণ্টকিত অনুন্নত দেশের সকল প্রাপ্তবয়স্ক মানসিকভাবে প্রস্তুত ও অপ্রস্তুত নরনারীকে ভোট দেয়ার অধিকারী করে।... গণতন্ত্র বিকাশের পক্ষে, নিরপেক্ষ বিচারে, এর ফল শুভ হয় নি। গণতন্ত্রের সাফল্যের আবশ্যিক শর্ত প্রকৃত শিক্ষা। (কিন্তু ভারতে) অদ্যাপি ধর্ম সমাজজীবন থেকে বিযুক্ত হয়ে বিশুদ্ধভাবে ব্যক্তির একক জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে নি। ধর্মীয় উৎসবে বা মিছিলের কারণে রাস্তায় যান চলাচল ব্যাহত হয়। প্রাথমিক অথচ কার্যকরী শিক্ষা সকলের কাছে দূরে থাক অধিকাংশের কাছেই পৌঁছানো যায় নি।... গণতন্ত্রের ভিত্তি শিক্ষা।” (‘কালের যাত্রার ধ্বনি’)
    ভারতের এই আয়নায় বাংলাদেশের মুখটিও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে আশা করি। আমরা ভোট দেয়ার অধিকার যাঁদের দিয়েছি তাঁদের বেশির ভাগকে আর কি দিয়েছি? বলছি গণতন্ত্র, কিন্তু গণতন্ত্রের ভিত গড়েছি কি? তাহলে এই গণতন্ত্র, এই গণতন্ত্রের মঙ্গল কাদের জন্য? আবার যাই বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে, “দেশের মঙ্গল? দশের মঙ্গল? কাহার মঙ্গল? তোমার আমার মঙ্গল দেখিতেছি, কিন্তু তুমি আমি কি দেশ? তুমি আমি দেশের কয়জন? আর এই কৃষিজীবী কয়জন? তাহাদের ত্যাগ করিলে দেশে কয়জন থাকে? হিসাব করিলে তাহারাই দেশ ? দেশের অধিকাংশ লোকই কৃষিজীবী।... যেখানে তাহাদের মঙ্গল নাই, সেখানে দেশের মঙ্গল নাই।” (‘বঙ্গদেশের কৃষক’, “বিবিধ প্রবন্ধ ? দ্বিতীয় ভাগ”, ১৮৯২)
    বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন উনিশ শতকের শেষ দিকে, আমরা এখন একুশ শতকের প্রথম দিকে। কথাগুলো কিছুটা হালনাগাদ করার প্রয়োজন আছে কি? না। গণতন্ত্র চলছে। চুপ!


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন