বৃহস্পতিবার, ২৯ মার্চ, ২০১২

হাত ধরে নিয়ে চলো সখা

ড. অমিতাভ চক্রবর্তী

আগামী ১লা বৈশাখ কবি সাযযাদ কাদিরের ৬৫তম জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ রচনা

মানুষের চলার পথে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা শেষ দিন পর্যন্ত মনকে আন্দোলিত করে। বর্ণময় করে রাখে হৃদয়। বছর দশেক আগে সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জে এক কবিতা-উৎসবে যোগ দিতে গিয়ে শীতের কুয়াশা জড়ানো সকালে ওই উজ্জ্বল প্রতিভাধর মানুষটিকে প্রথম দেখি। পঞ্চান্ন বছর বয়সেও সে যেন পঁচিশের যুবক। প্রায় সমবয়সী আমার। সাধারণ চেহারা অথচ উজ্জ্বল চোখ-মুখ। পরে পরিচয় প্রণয়ে পরিণত হয়। অসাধারণ প্রতিভা তার। সাহিত্য বিজ্ঞান দর্শন থেকে শুরু করে সমাজবিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় সহজ স্বচ্ছন্দ বিচরণ। এক জীবন্ত অভিধান। যত তাকে কাছ থেকে, দূর থেকে দেখি বিস্ময়ে বাক্যহীন হয়ে উঠি। এত পড়াশুনো কখন ও করে? কখন এত লেখে? ফিচার থেকে উপন্যাস, অনুবাদ থেকে শুরু করে প্রবন্ধ, কবিতা থেকে শুরু করে সম্পাদনা ? নিভৃতে নীরবে একটানা পঞ্চাশ বছর ধরে করে চলেছে দুই বাংলার জনপ্রিয় এই ব্যক্তিত্ব ? যার পরিচয় সাযযাদ কাদির নামে। সুফি সাধকের মতন নির্লোভ জীবন যাপন। সংসারের মায়াজালের মধ্যে থেকেও জ্ঞান আহরণের কঠিন ব্রত প্রত্যহ পালন করে চলেছে আমার প্রাণের প্রিয় বন্ধুটি ? যাকে মজা করে বলি ‘সাযপা৮৫’। হ্যাঁ, চর্যাপদের ৮৪ সাধক-কবির উত্তরসূরি সে, বাংলা ভাষা-সাহিত্যের অন্যতম সুসন্তান। ঘটনাক্রমে ও আমার মায়ের দেশ অর্থাৎ মাতুলদের জেলা টাঙ্গাইলের সুসন্তান। অসামপ্রদায়িক উদার মনোভাব। আরও জানার আগ্রহ, সহজ সরল জীবন যাপন আমার মতন সুরাসক্ত মানুষকে মুগ্ধ করে। লুব্ধ করে রাখে সারাক্ষণ।
    দেশ-বিদেশে বহু দিন থাকার অভিজ্ঞতা সাযযাদের বহু লেখায় বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। ওর কলম কখনও সমালোচনার সুরে হয়ে ওঠে ঝলসানো তরবারি। ভারতীয় উপমহাদেশে ও মহাচীনে যাতায়াত ও বসবাসের কারণে কবি সাযযাদ হয়ে ওঠেছে ঢাকা, কলকাতা ও পেইচিং-এর আপনজন। একজন বিশ্ব-নাগরিক। ঢাকার গ্রিন রোডে ওর সাজানো ফ্ল্যাটে দু’ একবার প্রবেশ করেছি। অসংখ্য পত্রপত্রিকা এবং হাজার-হাজার দুর্লভ গ্রন্থের ভাণ্ডার ?  দুষ্প্রাপ্য সামগ্রীর সে এক অমূল্য সংগ্রহশালা। পাগলের মতো হাজার-হাজার টাকা খরচ করে বই কেনে। সেই সঙ্গে আজন্ম রোমান্টিক মানুষটির সংগ্রহে আছে হারিয়ে যাওয়া সোনালি দিনের গান ও ছবির কয়েক হাজার সিডি ও ডিভিডি। মনে-মনে ভাবি, ওর স্ত্রী কি করে কবির এই পাগলামি সহ্য করে? বাইরে থেকে দেখে মনেই হয না চিন্তা-ভাবনায় ওর এত গভীরতা। দু’ দিনের জীবনকে, একটা জন্মকে কিভাবে পরিপূর্ণ ভাবে জ্ঞান আহরণে ও নতুন সমাজগঠনে ব্যয় করা যায়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ আমার প্রিয় সখা সাযযাদ। বানান ও ভাষা এবং বাক্যবিন্যাসে ওর দখল বাংলা সাহিত্যের বহু অধ্যাপকের কাছেও ঈর্ষার বিষয়। অসুস্থ শরীর নিয়েও ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজের অভিজ্ঞতা ওর আছে।
    বন্ধু আমার চিরসবুজ। যৌবনের প্রতীক বসন্তের অগ্রদূত। মাঝে-মাঝে ফোনে সুখ-দুঃখের কথা হয়। খুব অভিমানী বালকের মতন ওর ব্যবহার। রাগ-অনুরাগ এবং জোয়ার-ভাটার সন্ধিক্ষণে কবি সাযযাদের অবাধ বিচরণ। মাঝে-মাঝে বলে উঠি, ‘আমি যে পথ চিনি নে, হাত ধরে নিয়ে চলো সখা!’
    সাযযাদ প্রগতিশীল গণআন্দোলনের অন্যতম সৈনিক। সূর্যকে ঘিরে মহাকাশে যেমন এক ঝাঁক গ্রহ-উপগ্রহ আবর্তিত হয়, ঠিক সেই রকম সাযযাদের প্রতিষ্ঠিত বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এক ঝাঁক কবি-গল্পকার-নাট্যকার। সাহিত্য-আন্দোলনের যোগ্য সেনাপতি। ওর মনের ঔদার্য এবং সৌন্দর্য শত্রুকেও মিত্রে পরিণত করে। ওর মুখে কোনও দিন পরনিন্দা-পরচর্চা শুনি নি। বন্ধুবৎসল অজাতশত্রু এই মহান কবি।
    সাযযাদের বহু কবিতায় তাঁর নিজস্ব জীবন-দর্শন খুঁজে পাওয়া যায়। ‘পুরনো বাসা’ কবিতাটি যেমন ? এক মধ্যবিত্ত পরিবার যখন ভাড়া বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র ভাড়া যায়, তখন ফেলে আসা পোষা মেনি বেড়ালটার জন্য কবির সন্তান হারাবার মতন অসহায় কান্না-যন্ত্রণা আমাকেও এই বয়সে চোখে জল এনে দেয়। কি অসাধারণ কবির অন্তর্দৃষ্টি এবং বহিঃদৃষ্টি। ওর মণিমালা কবিতামালা বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সম্পদ।
রাজনৈতিক কারণে কবিকে বহুবার হেনস্তা হতে হয়েছে , কিন্তু সাযযাদ কখনও হাল ছাড়ে নি। জীবনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে নি। এপার-ওপার বাংলার বহু ধান্দাবাজ স্বার্থপর মানুষ সাযযাদের কাছ থেকে অসংখ্যরকম সাহায্য নিয়েছে, কিন্তু সেই বেইমান বিশ্বাসঘাতকদের কবি ‘ক্ষমাই সুন্দর’ মনে করে ক্ষমা করে দিয়েছে। এই ঔদার্য এবং মহানুভবতা একালের মানুষের মধ্যে দেখাই যায় না।
মহাজগতের অজানা রহস্য কবিকে আকৃষ্ট করে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ওকে বিমুগ্ধ করে রাখে। শিশুদের মন জয়ের জন্য নানান দেশের অসংখ্য লোকরচনা ভাষান্তর করেছে। দুই বাংলার হারিয়ে যাওয়া লেখকদের ওপর আমাকে অসংখ্য গ্রন্থ প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে পাঠায়। বিনিময়ে ওর করুণ প্রার্থনা । বন্ধুর কাছে আবদার ‘বই পাঠাও’। ‘আরও বই’। ‘বাংলা বই’।
সাযযাদ একজন উঁচু মাপের সাংবাদিক। একদা জনপ্রিয় অধ্যাপক এবং এখন দুই বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। ওর সঙ্গে আমার পরিচয় আমাকে গর্বিত করে। আমি অহঙ্কারী হয়ে উঠি যখন ভাবি ওই বিদগ্ধ পণ্ডিত মানুষটি আমার বন্ধু । আমাকে ভালবাসায় জড়িয়ে রেখেছে।
আন্তর্জাতিকতাবাদী-মানবতাবাদী হয়েও কবির কলমে বিদ্রূপ পরিহাস বহু লেখায় স্পষ্ট। মানুষের স্বভাব যে কাকের চেয়েও অধম, সেই বিষয়ে সাযযাদের লেখা সামান্য ‘কাক’ বিষয়ক কবিতা অসামান্য হয়ে উঠেছে। বহু বছর আগে পড়েছিলাম ওর কবিতা পড়েছিলাম চট্টগ্রাম থেকে ’৭২ সালে প্রকাশিত ‘রৌদ্র-দিন’ পত্রিকায়। তখন ওর সঙ্গে পরিচয় ছিল না। কবি মেসবাহ খানের সৌজন্যে আমিও ওই পত্রিকায় লিখি। তারপর বহু বছর বাদে ওকে আলিঙ্গন করার সৌভাগ্য হয়। আড্ডাবাজ কবির বাড়িতে স্নেহময়ী ভাবীর হাতের চা-পান, সাহিত্য-আলোচনা সবই এ জন্মের পরম প্রাপ্তি। প্রিয় কবি-বন্ধুর দীর্ঘ সাহিত্যজীবন ও সুস্বাস্থ্য প্রার্থনা করি।

ঙ ড. অমিতাভ চক্রবর্তী: কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক; রিডার, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, দমদম মতিঝিল কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন