বৃহস্পতিবার, ২৯ মার্চ, ২০১২

‘যেটুকু যা পারি তা-ই নিয়ে আছি’

অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় কবি সাযযাদ কাদির
ষাটের দশকের শীর্ষস্থানীয় কবি, কথাসাহিত্যিক, কলামনিস্ট, সাংবাদিক সাযযাদ কাদির এ দেশে বিরল গোত্রের একজন বহুমাত্রিক লেখক। বিচিত্র বিষয়ের প্রাঞ্জল উপস্থাপনা তাঁর রচনার প্রধান আকর্ষণ। প্রচলিত প্রচারমুখী মানসিকতার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়েও শিল্প-সাহিত্যের জগতে তিনি অর্জন করেছেন এক মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান। তাঁর মেধাবী মননশীল লিখন-চর্চার জনগ্রাহ্যতা যেমন, তেমনই রয়েছে জনপ্রিয়তাও।
সাযযাদ কাদির লিখে চলেছেন অবিরাম। তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় ষাট ছাড়িয়েছে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ, শিশুতোষ সহ নানা বিষয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ তিনি লিখেছেন অত্যন্ত সুচিন্তিত ও সাবলীলভাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স সহ মাস্টার্স এই চিরনবীন মানুষটি শিক্ষকতা করেছেন, সম্পাদনা করেছেন দেশের জননন্দিত সাপ্তাহিক ও দৈনিক। বর্তমানে তিনি দৈনিক মানবজমিনের যুগ্মসম্পাদক। আগামী ১লা বৈশাখ (১৪ই এপ্রিল) কবির ৬৫তম জন্মদিন। সমপ্রতি লেখালেখি ও কর্ম-বর্ণাঢ্য জীবনের নানান দিক নিয়ে কথা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। সেই আলাপচারিতার কিছু অংশ পাঠকদের জন্য তুলে এনেছেন কবি-সাংবাদিক সাবিত সারওয়ার।

: দেখতে-দেখতে  পেরিয়ে এলেন এতটা বছর। কেমন লাগছে আপনার?
? তা ৬৫ বছর কাটলো! মাঝেমধ্যে বিস্ময় লাগে বড়। আমার তো বাঁচার কথা ছিল না! বারবার আক্রান্ত হয়েছি রোগে ও ঘাতকের হামলায়, শিকার হয়েছি দুর্ঘটনার। মরতে-মরতে বেঁচে এসেছি কতবার! ভাবি, কি করে যে বেঁচে আছি! কত বার যে মৃত্যুর কথা প্রচার হয়েছে আমার! আরও এক বিস্ময় আছে আমার। সেই ১৯৫৮ সালে, তখন আমি সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র, মনে-মনে নিজের জন্য চেয়েছিলাম মাত্র তিনটি সুযোগ ? সারা জীবন যেন অব্যাহতভাবে বই পড়তে, গান শুনতে ও ছবি দেখতে পারি। জীবনে আর কোনও ইচ্ছা পূরণ না হলেও এ ইচ্ছা তিনটি ভালভাবেই পূরণ হয়েছে আমার। দেশ-বিদেশ থেকে মনের মতো বই যোগাড় করে পড়ছি সবসময়েই, টিভি ইনটারনেট সিডি ডিভিডি’র কল্যাণে বহু দুর্লভ গান শুনছি, ছবি দেখছি। ১৯৬৫’র পর আমার পড়া, শোনা ও দেখার জগতে যে বিচ্ছেদ ঘটেছিল তার পুনরুদ্ধার হয়েছে পুরো মাত্রায়। সেই ভাল লাগাটা আছে আমার মধ্যে। 

: আপনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক আবার একজন সাংবাদিকও। লেখালেখির কোন শাখাতে আপনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন? কেন?
? লিখতে কোনও অস্বাচ্ছন্দ্য নেই আমার, তা যা-ই লিখি। সব লেখাই লিখি অনেক ভেবেচিন্তে, সময় নিয়ে। ভাবনাটা যেমন মনে আসে, তেমন মনে-মনে তা রচনাও হয়ে যায়। তারপর লিখে ফেলি ধীরেসুস্থে, তাড়াহুড়া করি না। কিছু দিন পর ওই লেখা সম্পাদনা ও পরিমার্জনা করি। সাংবাদিক হিসেবে উপস্থিত প্রয়োজনের লেখা লিখতে আমি অভ্যস্ত, সেখানেও অস্বাচ্ছন্দ্যের কিছু ঘটে নি কখনও। আসলে আমার মনের কথাটি আমি সবসময়ই চাই মুখের ভাষায় লিখতে। বানিয়ে-বানিয়ে কিছু লিখি না, লিখতে গিয়ে অশালীন-অমার্জিতও হই না। এ কারণে স্বচ্ছন্দ থাকি সব ধরনের লেখাতেই। কিছু দিন আগে চাপের মধ্যেও লিখেছি, এখন আর চাপ নিচ্ছি না কোনও। এখানে বলি, মনে যত ভাবনা আসে? মনে-মনে যত রচনা হয় ? তার বেশির ভাগই শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখে না। আর কখনও-কখনও, পত্রিকার ডেডলাইন মানতে হয় বলে, কোনও-কোনও লেখা দ্রুত শেষ করেই পাঠিয়ে দিতে হয়।

: সমপ্রতি পাক্ষিক বৈচিত্রে আপনার নিয়মিত একটি কলাম ছাপা হচ্ছে ‘প্রিয়রা পরস্পরে’।  লেখাটি বাংলাসাহিত্যের শেকড়ের কথা বলে। তথ্যভিত্তিক এই লেখাটির পাঠকও দিনে-দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেন এবং কিভাবে ব্যতিক্রমী এই বিষয়টি আপনার চৈতন্যে ধরা দেয়?
? রবীন্দ্রনাথ আমার প্রিয় গীতিকবি, সুরকার, কথাশিল্পী, চিন্তাবিদ, কর্মনায়ক, মানুষ এবং বিষয়। সেই ছোটবেলা থেকে পড়ছি, জানছি তাঁকে। স্কুল কলেজ ’ভারসিটিতে পড়েছি, পড়িয়েছি, আলোচনা করেছি, বলেছি, তবে তিনটির বেশি প্রবন্ধ লিখি নি। এর মধ্যে আমার শ্রদ্ধেয় প্রিয়জন কবি মনজুরে মওলা বললেন রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর শান্তিনিকেতন সম্পর্কে আস্ত একটা বই লিখতে। লিখতে গিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি অনেক। নতুন করে চিনতে পারি রবীন্দ্রনাথকে। ‘রবীন্দ্রনাথ : শান্তিনিকেতন’-এর পর লিখে ফেলি আরও একটি বই ‘রবীন্দ্রনাথ : মানুষটি’। এতে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক সংগ্রহ আমার জমে যায় অনেক। এ সব নিয়ে আরও কয়েকটি আকর্ষণীয় বই লিখতে পারি সহজেই। ভাবি, লিখবো। ঠিক করি কোন-কোন বিষয়ে লিখবো। তারপর বেছে নিই এই ‘প্রিয়রা পরস্পরে’।

: আপনার সমকালে কিংবা জানা মতে যাঁরা লেখালেখির শুধুমাত্র ঝুল ধরে ঝুলে আছেন তাঁদের অনেকে নামী প্রতিষ্ঠানের দামি পুরস্কার পেয়েছেন। আপনার ভাগ্যবিড়ম্বনার উৎস কি? একটু যদি বলতেন?
? লেখালেখির সঙ্গে পুরস্কারের তেমন সম্পর্ক আছে বলে মনে করি না। লেখার সময় পুরস্কারের কথা কেউ ভাবেন বলে জানি না, আমিও ভাবি না। লেখার সময় আমার সামনে, চারপাশে লেখার বিষয়ই থাকে। তাই পুরস্কার না পাওয়াটাকে আমি ‘ভাগ্যবিড়ম্বনা’ মানতে পারছি না। এ ছাড়া আমি বরাবরই প্রতিষ্ঠাবিরোধী, তাই কোনও নামী প্রতিষ্ঠানের তকমা আমার জন্য নয়। তবে পুরস্কার সম্পর্কে শুনেছি, ওগুলো নাকি দেয়া হয় না, নেয়া হয়। তাহলে বলতেই হয়, নেয়ার ক্ষেত্রে কোনও যোগ্যতাই নেই আমার।

: আমরা জানি ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে বিশেষ সাংগঠনিক ভূমিকা ছিল আপনার। ’৭১-এ ছিলেন টাঙ্গাইলে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। হানাদার বাহিনী কর্তৃক আটক হয়ে বন্দিশিবিরে নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আবার ’৯০-এ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। অথচ বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে আপনাকে নিষ্ক্রিয়ই মনে হয়। বিষয়টি কেন যেন রহস্যের মনে হয়। ভুল বলেছি নাকি?
? আমি রাজনীতিমনস্ক, রাজনীতিসচেতন মানুষ। তবে কোনও রাজনৈতিক সংগঠনে জড়িত নই। ছাত্রজীবনে অল্প কিছু দিন ছাত্রসংগঠনে যুক্ত ছিলাম, পরে যুক্ত হয়েছি বিভিন্ন সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনে। কিছু আনুষ্ঠানিক কাজ করতে হয় এজন্য। ’৬৯, ’৭১ ও ’৯০ রাজনৈতিক ছিল না, ছিল দেশ ও জাতির মুক্তির সংগ্রাম। এ সংগ্রাম ছিল সর্বজনীন। ওই সময়ে আমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ পেয়েছি আমার বিশেষ অবস্থানগত কারণে। ’৬৯-’৭১এ আমি ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ছাত্র, ’৯০এ ছিলাম সাংবাদিক সমাজের শীর্ষস্থানীয় নেতা। আর একাত্তরে ওটা ‘বন্দিশিবির’ ছিল না, ছিল মৃত্যুশিবির ? ডেথক্যাম্প। হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যেতো নির্যাতন চালিয়ে হত্যার জন্য। ওখান থেকে প্রাণ নিয়ে ফেরা অলৌকিক উপায় ছাড়া সম্ভব ছিল না। আমার বেলায়ও হয়েছিল তা-ই। ঘটেছিল অলৌকিক কিছু। আমার বর্তমান ভূমিকা সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, আমি লেখক ? রাজনীতিক নই। লেখক হিসেবে লেখালেখিতে আমি যথেষ্ট সক্রিয়। আমার লেখায় প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক ইস্যু অবশ্যই উপস্থিত থাকে। প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সমালোচনা থাকে, আক্রমণ থাকে। তবে আমার ভাষা উগ্র নয়, যুক্তি-প্রমাণসিদ্ধ, গণতান্ত্রিক।  এতে কোনও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থাকে না। কারণ আমি লিখি জনগণের পক্ষে এবং জনগণের জন্য। আর আমি কোনও শক্তির কাছে নতজানু নই। বরাবরই আমি সংরক্ষণ করি আমার ভিন্নমত পোষণের ও সমালোচনা করার অধিকার। আমার ভূমিকা স্পষ্ট, এতে রহস্যের কিছু নেই।

: লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি। সম্বোধনের অনেক শব্দ থেকে কোনটিতে আপনি বেশি খুশি হন? কেন?
? যখন শরীরে সামর্থ্য ছিল, তখন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সংক্রান্ত জানাশোনায় ঘাটতি ছিল কম, জ্ঞান ছিল অপরিপক্ব। এখন এই এতদিনে একটু পেকেছি মনে হয়, কিন্তু খুইয়েছি শক্তিসামর্থ্য। ফলে যত কিছু ? যা কিছু লিখতে পারতাম তা আর পারছি না। অল্প নিয়ে আছি। যেটুকু যা পারি তা-ই শুধু করি। এটাই আমার ভবিষ্যৎ। সম্বোধনের ব্যাপারে বলতে হয় ? আমাকে ‘স্যর’ সম্বোধনটাই এখন প্রতিষ্ঠিত। দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছি, দেশে-বিদেশে, এখনও করছি। এ সূত্রেই আমার ছাত্র-ছাত্রীদের এ সম্বোধনটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আর বহু জনসংযোগপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে দায়িত্ব পালন করেছি, সে হিসেবেও ছড়িয়েছে ‘স্যর’ সম্বোধনটি। এছাড়া টাঙ্গাইলের মুক্তিযোদ্ধারা ‘স্যর’ সম্বোধন করে আমাকে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের বাল্যবন্ধু হিসেবে এ সম্মান জানায় তারা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন