শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২

সব্যসাচী সাযযাদ কাদির

মাহমুদ কামাল
ইদানীং বেশ কয়েকজন লেখকের নামের আগে ‘সব্যসাচী’ শব্দটি বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মহাভারতের অর্জুন দু’হাতে বাণ নিক্ষেপ করতে পারতেন বলে বিশেষায়িত সব্যসাচী নামটি যেমন পুরাণে প্রতিষ্ঠিত সেই অর্থের আদলেই যাঁরা সাহিত্যের সকল শাখাতেই সফলভাবে কলম চালাতে পারেন তাঁদের নামের আগে এই বিশেষণটি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। সেই অর্থেই কবি সৈয়দ শামসুল হক সব্যসাচী লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ষাটের অকাল প্রয়াত কবি আবু কায়সার (১৯৪৫-২০০৫)-এর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ আমরা (কবি মোহাম্মদ আবদুল মাননানের সঙ্গে যৌথ) বের করেছিলাম ‘সব্যসাচী আবু কায়সার’ শিরোনামে। কবি আবু কায়সার দু’হাতে নানা বিষয়ে লিখতে পারতেন বলেই স্মারক গ্রন্থের ওই শিরোনামটি আমরা দিয়েছিলাম। ষাটের বিশিষ্ট কবি সাযযাদ কাদির কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ-গবেষণা, নিবন্ধ-ফিচার, শিশুতোষ লেখা অর্থাৎ সৃষ্টিশীল ও মননশীল সব ধরনের লেখায় সমান পারদর্শী। ‘ভাষাতত্ত্ব পরিচয়’ নামে তাঁর একটি ছোট গ্রন্থ রয়েছে যেটি শিক্ষার্থীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য। ‘সব্যসাচী সাযযাদ কাদির’ এই শিরোনামটি তাঁর বেলায় স্বয়ংক্রিয় ভাবেই প্রযোজ্য একথা আমি দ্বিধাহীনভাবেই জ্ঞান করি। তাঁর সাহিত্যকীর্তি সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করার আগে ব্যক্তিগত কিছু বিষয় এখানে উল্লেখ করছি। সাহিত্য সৃষ্টিতে যেমন তিনি সব্যসাচী, পেশাগত জীবনেও তিনি বদল করেছেন নানাবিধ চাকরি। অধ্যাপনা, নানা পত্রিকায় সাংবাদিকতা, সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা প্রভৃতি কাজ তিনি করেছেন, কিন্তু কোথাও মাথা বিক্রি কিংবা আপস করেন নি। আজীবন প্রতিষ্ঠাবিরোধী তিনি দলবাজি করেন নি বলেই দলীয় বিবেচনায় যাঁরা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার-টুরস্কার পাচ্ছেন দীর্ঘদিন থেকে তাঁদের বাইরেই রয়েছেন। তাঁর অধ্যাপনা জীবনে প্রায় দু’বছর আমি উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে সরাসরি ছাত্র ছিলাম। শিক্ষক হিসেবে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন পাঠদান পদ্ধতির কারণে। আমরা কখনও তাঁর ক্লাশ ফাঁকি দিতাম না। সা’দত কলেজ থেকে তিনি যোগ দেন সাপ্তাহিক বিচিত্রায়, ১৯৭৬ সালে। এরপর তাঁর পেশার নানা পরিবর্তন ঘটে যেতে দেখি।
তাঁর বেশ কিছু গুণের মধ্যে একটি হলো প্রখর স্মৃতিশক্তি। শক্তিটি এমন, তাঁর মাথায় একটি তথ্যব্যাংক রয়েছে যেখান থেকে অনেকেই উপকৃত হয়েছেন। শব্দের বানান অথবা অর্থ কিংবা যে  কোনও লেখক বা গ্রন্থের নাম প্রভৃতি তিনি অবলীলাক্রমে বলে দিতে পারেন। আরেকটি গুণ ক্ষমতানুযায়ী মানুষকে সহযোগিতা করা। ভালমন্দ মিলিয়েই মানুষ। যেহেতু আমি তাঁর ছাত্র ছিলাম এ জন্য মন্দ বিষয়গুলো না বলাই উচিত। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের ছাত্রটিও এখন শিক্ষক। তাঁর ছাত্রও শিক্ষকতা করে। এই সাহসে আমার শিক্ষকের একটি নেতিবাচক দিক এখানে উল্লেখ করি। তিনি খুব সহজেই ভুল বোঝেন; সাহিত্য সম্পর্কে নয়, ব্যক্তি মানুষ সম্পর্কে। যতটুকু জানি ভুল বোঝার কারণে তাঁর বন্ধুর সংখ্যা কম। একজন শক্তিমান লেখকের জন্য এ বিষয়টি অদরকারি। আশা করি আমার এই আকাট মন্তব্যে তিনি ভুল বুঝবেন না।
সাযযাদ কাদির সব্যসাচী লেখক হলেও কবি পরিচয়ে তিনি শ্লাঘা বোধ করেন। এই  বিবেচনায় এখন থেকে তাঁর নামের আগে কবি শব্দটি ব্যবহৃত হবে।
কবি সাযযাদ কাদির দশক বিচারে গত শতকের ষাটের কবি হিসেবে পরিচিত। যেহেতু তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন ছাত্র এবং পরে শিক্ষক ছিলেন ? এ কারণে তাঁর কবিতা যেমন প্রথানুগ আবার প্রথাবিরোধীও। সাহিত্যের রীতি-নীতি অক্ষুণ্ন রেখে তিনি কবিতা রচনা করার কারণে তাঁর কবিতা প্রথাগত কিন্তু কবিতার বক্তব্য প্রকাশে প্রথাবিরোধী। আবার কখনও-কখনও রচনা পদ্ধতি প্রথাবিরোধী কিন্তু কবিতার বিষয় প্রথার বাইরে নয়। অর্থাৎ তিনি কোনও সীমানার মধ্যে নিজেকে আটকে রাখেন না। তিনি জীবনকে দেখেছেন তাঁর মতো করে। কথাসাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি উক্তি এরকম, ‘সৃষ্টিকর্তার কোনও ডুপ্লিকেট নেই। পাওয়ার অভ অ্যাটর্নিও নেই।’ একারণে কবির সৃষ্টি একান্তই কবির। সেই সৃষ্টিশীলতায় যদি নিজস্বতা থাকে এবং তা যদি সামগ্রিকতা পূর্ণ হয় তাহলে তিনি আলাদা হবেন না কেন।
সাযযাদ কাদিরের কবিতা যেমন ছন্দোবদ্ধ তেমনি ছন্দহীন, কিন্তু উভয়ই সৃষ্টিশীল। কবিতাকল্পনালতা এবং প্রচলিত বাস্তবতার মিশেলে তার কবিতা কখনও হয়ে ওঠে পরাবাস্তবতার ডানা। ‘খাদ্যতালিকা’ কবিতাটি নজর করে এই মন্তব্যের সত্যাসত্য খোঁজ করা যেতে পারে। দীর্ঘ কবিতাটির কয়েকটি পঙ্‌ক্তি উদ্ধৃত করি:
“আমার একটি হাত  সহসা দীর্ঘ হতে-হতে
জ্যোৎস্নাকে অতিক্রম করে যায়;
যেন হাত নয়, যেন হাতিয়ার,
যেন ত্বকের  গভীর থেকে বেরিয়ে আসা
এক স্বয়ংক্রিয় হোস্‌পাইপ।
...

নিরাঙ্গুরীয় পাঁচটি আঙুলের নিম্নবিত্ত যে হাত
কোনও দিন সিনেমার টিকিট
    বা প্রিয়জনের জন্য উপহার
           কোনও কিছুই কেনে নি,
চিরায়ত সাহিত্য
     বা দৈনিক পত্রিকা
     কোনওটিরই পৃষ্ঠা ওলটায় নি,
প্রাচীন বা আধুনিক
     কোনও ধর্মগ্রন্থই ছুঁয়ে দেখে নি,
চিরস্মরণীয়া বা ক্ষণিকা
        কাকেও তেমন স্পর্শ করেনি;
...

সেই বিপন্নতায় আমার কি কোনও দিন যাওয়া হবে?
কোনও স্বেচ্ছাচার আমাকে কি কোনও দিন সঙ্গী করে নেবে?
তবু সে আমার হাত,
তবু সে আমার হাত নয়, যেন হাতিয়ার,
যেন ত্বকের গভীর থেকে বেরিয়ে আসা
নিশ্চিত হরিণীর প্রতি স্পষ্ট জ্যোৎস্নায়
        ধাবমান এক চিতা...”

তাঁর কবিতা উপচে-পড়া আবেগতাড়িত নয়। জীবনকে ছুঁয়ে-ছেনে বাক্যের কাঠামোবিন্যাস করেছেন নিপুণ শক্তিতে। ‘সমস্ত মুখের রেখায় স্থির হয়ে থাকে অন্ধকার’ ? তিনি এই অন্ধকারকে সরিয়ে দিয়ে গর্বিত স্বাধীনতা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করেন। এরকম শ্রেয়োচেতনা লক্ষ্য করা যায় তাঁর বিভিন্ন কবিতায়।
তাঁর কবিতার বিশেষ গুণ সহজবোধ্যতা। শব্দের মারপ্যাঁচ নেই, বাক্যের চাতুরি নেই, কিন্তু অপূর্ব চিত্রকল্পের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় তাঁর বিভিন্ন কবিতায়। এরকমই একটি কবিতা ‘দরজা খুললেই’। তাঁর অনুরাগী পাঠক হিসেবে এটি আমার প্রিয় কবিতা। এই কবিতার পুরোটা উদ্ধৃত করে কবি এবং কবির সাহিত্যকর্মকে আমি শ্রদ্ধা জানাতে চাই।
“দরজা খুললেই চিকিৎসক
পথে নামলেই অ্যামবুলেন্স
যে কোনও বাড়িই হাসপাতাল
- আমার খুব অসুখ হলো কি
অঘ্রাণের চাঁদে সাঁতার দেয়ার পর?

আসলে এক ছায়া,
ছায়া বলি কেন নিঃসন্দেহে ভূত,
তার শরীর ও শরীরের হাওয়া এবং শোকগীতি
সহজ অনুগমন শিখেছে, ?
যেখানে-সেখানে করতালি বাজিয়ে
খুলে দিচ্ছে দরজা, রাজপথ আর রমণীর অন্তঃপুর
? এ-সবের শুশ্রূষা করবেন কোন মহাশয়?

আমি বলি,
চাঁদ ও চাঁদের ছায়ায় কিছু ভুল-বোঝাবুঝি ঘটেছে,
মূলত ওই চুলের অন্ধকারেই
চন্দ্রায়িত রমণীর আঙুলে
প্রেম বা প্রতিহিংসা বুনেছিল,
আমি কিছু ভালবাসার অসুখে
শরীর গরম করি নি,
অথচ দরজা খুললেই ...”

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন