বৃহস্পতিবার, ২২ মার্চ, ২০১২

একজন জাহিরুল হাসান

কবি জসীম উদ্‌দীন সম্পর্কে লিখতে গিয়ে, ক’ দিন আগে, উসখুস করেছি খুব। হাতের কাছে ভাল একটা জীবনী ছিল না তাঁর। ২০১১ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি জাতীয় কবিতা উৎসবের এক সেমিনারে আমি ছিলাম সভাপতি, আলোচক ছিলেন শ্রদ্ধেয় পবিত্র সরকার। অনুষ্ঠানের ফাঁকে-ফাঁকে নানা বিষয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তখন কি এক প্রসঙ্গে কথায়-কথায় বলেছিলেন, ‘জসীম উদ্‌দীনের সেরা জীবনীটি লিখেছেন জাহিরুল হাসান। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি ছেপেছে।’ খোঁজখবর নিতে বলেছিলেন, ‘বইটি ছাপা নেই এখন।’ লেখার সময় সে কথাটা মনে পড়েছে বারবার। উসখুস করেছি সেজন্যই। মজার ব্যাপার ? লেখা শেষ, ছাপা শেষ ? তারপর সে বই এসে যায় হাতে।  হঠাৎ আজিজ সুপারমারকেটে গিয়ে সেটা পেয়ে যাই এক দোকানে। বাসায় ফিরে আগাপাশতলা উলটেপালটে নেড়েচেড়ে পড়ে ফেলি সে বই। আমি অবশ্য সেই ছোটবেলা থেকেই মনের মতো বই পেলে এভাবেই আস্ত বই হাপিস করি।
    পবিত্র সরকার হয়তো খবর পান নি জাহিরুল হাসানের ‘জসীম উদ্‌দীন’-এর দ্বিতীয় সংস্করণ বাজারে এসেছে আগের মাসে। এর প্রথম সংস্করণও বেরিয়েছিল জানুয়ারিতে, ২০০৬ সালে। বইটি সম্পর্কে সমালোচকেরা তখন মন্তব্য করেছেন ? ‘অসাধারণ’, ‘অত্যন্ত মনোজ্ঞ জীবনী’, ‘নানা অজানা তথ্য পেশ করার ধরনটি সুন্দর’, ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রকাশিত জীবনীগ্রন্থমালার অন্যতম উল্লেখযোগ্য জীবনী’, ‘ছোট অথচ চমৎকার জীবনী’। প্রতিটি মন্তব্যই যথার্থ। অক্লান্ত পরিশ্রমে সংগৃহীত সকল তথ্যপ্রমাণ ঘেঁটে জসীম উদ্‌দীনের জীবনের খুঁটিনাটি নানা দিক, বলতে গেলে প্রায় সব দিকই তুলে ধরেছেন জাহিরুল হাসান। এই তুলে ধরায় দেখতে পাই তাঁর গভীর মনোনিবেশ, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশক্তি, নৈর্ব্যক্তিকতা, নিরাসক্ত গবেষকের মূল্যায়ন-বিশ্লেষণ। এ বই পড়েই জানতে পারলাম বাংলা একাডেমী’র ‘চরিতাভিধান’-এ কত কি ভুল আছে জসীম উদ্‌দীন সম্পর্কে। যেমন, তাঁর জন্ম ও মৃত্যু তারিখ।  অর্থাৎ জসীম উদ্‌দীনের জন্মতারিখ ১৯০৩ সালের ১লা জানুয়ারি না-ও হতে পারে, আর মৃত্যুতারিখ ১৯৭৬ সালের ১৩ই মার্চ নয়, ১৪ই মার্চ। এছাড়া জসীম উদ্‌দীন যে ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমীর সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সে তথ্যটিও পেলাম এ বইয়ে। তবে কিছু-কিছু বিষয় ছুঁয়েই চলে গেছেন তিনি। বিশেষ করে ব্যক্তি জসীম উদ্‌দীনের নানা দিক। যেমন লিখেছেন, “তাঁর মোট ছ’টি সন্তান, চার ছেলে ও দুই মেয়ে।” কিন্তু তাঁদের নাম-ধাম পরিচয় তুলে ধরেন নি কিছু। কেবল বলেছেন ? ছোট মেয়ে ছাড়া সবাই উচ্চ শিক্ষা পেয়ে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত আর “বড় জামাতা মওদুদ আহমদ ব্যারিস্টার এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী।” আর ‘মেয়ে হাসনা’র উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছেন রসগোল্লা ফুটিয়ে খাওয়ার ঘটনা। কিন্তু তিনি কোন মেয়ে  ? বড় না ছোট ? বলেন নি এটুকুও। “ফরিদপুরের তরুণ তমিজউদ্দিন ওকালতি ছেড়ে কলকাতায় জাতীয় বিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দিয়েছিলেন” ? এটুকু মাত্র তথ্য দিলেন, পুরো নামও বললেন না যাঁর ? তিনি অন্য কেউ নন প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ তমিজউদ্দীন খান (১৮৮৯-১৯৬৩)। ১৯২৬ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে তিনিই পরাজিত করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলামকে। জাহিরুল হাসান ওই নির্বাচন নিয়ে লিখলেন, নজরুলকে পির বাদশা মিয়ার সমর্থন দেয়ার খবরও দিলেন, কিন্তু নির্বাচনে নজরুলের যিনি প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তাঁর নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করলেন না।
এ ধরনের ‘ছুঁয়ে যাওয়া’র উদাহরণ খুব বেশি নেই বইয়ে। কিন্তু যেখানে বিস্তর বিশদ তথ্যের আয়োজন, অগণ্য অ-গণ্যজনের উল্লেখ-উদ্ধৃতি, সেখানে এ অভাবগুলি চোখে পড়বেই। তবে জাহিরুল হাসান সাহিত্য-অঙ্গনে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছেন ‘সাহিত্যের ইয়ারবুক’ সঙ্কলন-সম্পাদনার জন্য। সাহিত্যমনস্ক নকল শিক্ষক শিক্ষার্থী লেখক গবেষক সাংবাদিক প্রচারক প্রকাশকের জন্য জরুরি এই ‘বাংলা সাহিত্যের তথ্যভাণ্ডার’। ১৯০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১০ বার প্রকাশিত এ ইয়ারবুকের একাধিক সংস্করণও হয়। এতে বোঝা যায় এর পাঠকপ্রিয়তার পরিমাণ। ২০১০ ও ২০১১ সালের ইয়ারবুক পেয়েছি আমি। একটিই অভাব বোধ করেছি ? সাহিত্যিকদের জন্মস্থান ও জন্মতারিখ স্থান পায় নি এতে। আর জাহিরুল হাসানের উদারতার কথা তো আগেই বলেছি। তার সুযোগ ভালভাবেই পায় অ-গণ্যরা।
কবি-লেখক ও শিল্পীদের সুলুকসন্ধান দিলেও নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখেছেন জাহিরুল হাসান। সহজে জানার উপায় নেই তাঁর পরিচয়-বৃত্তান্ত। জেনেছি সরকারি আয়কর-কর্মকর্তা ছিলেন তিনি, অবসরে আছেন এখন। জন্ম ১৯৪৬ সালে। থাকেন কলকাতার কবিতীর্থ সরণিতে। ‘জসীম উদ্‌দীন’-এর মতো সুখ্যাত তাঁর আরও দু’টি জীবনীগ্রন্থ ? ‘কাজী আবদুল ওদুদ’ ও ‘রেজাউল করীম’। এছাড়া তাঁর পাঠকপ্রিয় বইয়ের তালিকায় রয়েছে ? ‘বিশ শতকের বাঙালি প্রতিভা’, ‘সাহিত্যসঙ্গী’, ‘কলমের জাদু’, ‘উর্দু ভাষা ও সাহিত্য’। তবে তাঁর কীর্তিগ্রন্থ ‘বাংলায় মুসলমানের আটশো বছর’। গত বছর কলকাতা থেকে প্রকাশিত এ বইটি এ বছর প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা থেকে।
১২০৪ সালে বাংলায় তুর্কি মুসলমানরা আসে ? সে হিসাবে এই আট শ’ বছর। ‘প্রস্তাবনা’য় লেখক এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “... এখন এদেশের অধিকাংশ বাঙালিই মনে করেন যে, ইংরেজ না এলে বাঙালি ভারতের সবচেয়ে অগ্রগণ্য জাতিতে পরিণত হতে পারত না। কিন্তু ১২০৪ সালে বখতিয়ার (ইখতিয়ার) খলজির নদিয়া বিজয় সম্পর্কে কোনও আবেগ তাঁদের মনে নেই। না থাকলেও ছশো বছরের সুলতানি ও মোগল শাসন বাঙালির স্বরূপকে যে সম্পূর্ণ পালটে দিয়েছে এবং সেই পরিবর্তনেরও যে ইংরেজ শাসনের মতোই বেশ কিছু ইতিবাচক দিক আছে ? এ কথা একটু ভেবে দেখলে বোধহয় তাঁরাও স্বীকার করবেন। এই পরিবর্তনের একটি অনিবার্য ফলশ্রুতি (ফল) হল বাঙালি সমাজের ভিন্নতর ধর্মীয় বিন্যাস, হিন্দু ও মুসলমান দুই বৃহৎ সমপ্রদায়ে বাঙালির বিভাজন।... তুর্কিরা আসার আটশো বছর পূর্ণ হল মাত্র কয়েক বছর আগে। এই পূর্তি ঐতিহাসিকদের নজর এড়িয়ে গেছে। একে উপলক্ষ করে কোথাও কোনও সেমিনার বা কোনও বিশেষ প্রকাশনারও আয়োজন হয় নি। একটু দেরি হয়ে গেছে, তবু মনে হয় এই আটশো বছরের ইতিহাসের একটা পর্যালোচনা জরুরি।... সে উদ্দেশ্যেই এই বইটি লেখা।...”
জাহিরুল হাসান লিখেছেন, বইটি ‘ঠিক ধারাবাহিক ইতিহাস নয়, খণ্ড-খণ্ড প্রবন্ধের সঙ্কলন, সাজানো হয়েছে সময়ের ধারাবাহিকতা মেনেই। এ ইতিহাস শুধু মুসলমানের ইতিহাস নয়, গোটা বাঙালি জাতিরই ইতিহাস।...”
তাঁর এই দাবিতে অতিশয়োক্তি নেই এতটুকু। বইয়ের সূচি দেখলেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ? বাংলায় ইসলামের উৎস ও বিস্তার, সুকুমার সেনের ‘ইসলামি বাংলা সাহিত্য’ বইটির আলোচনা, মুসলিম মননে বঙ্কিমচন্দ্র ও ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস, মীর মশারফ হোসেনের নারীচরিত্র এবং মুসলিম নারী প্রগতি, জসীম উদ্‌দীনের স্মৃতিকথায় বাংলা ও বাঙালি, বঙ্গভঙ্গের মুসলমান দিক, কাজী আবদুল ওদুদের চিন্তাধারা, ছেচল্লিশের দাঙ্গা, দেশভাগের আবর্তে মুসলিম সমাজ, প্রবন্ধসাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাজগৎ, ছোটগল্পে মুসলিম সমাজ, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের জটিলতা। পড়তে-পড়তে আলোকিত হই নানা বিষয়ে। হঠাৎ জেনে যাই ‘বাংলাপিডিয়া’য় বাংলা সাহিত্যের আলোচনায় ‘মুসলিম বাংলা লিটারেচার’ শীর্ষক আলাদা উল্লেখ আছে। নতুন করে আলোক পাই আমাদের মানসগঠনের নিকট-ইতিহাস সম্পর্কে:
“১৯১১ সালে ভাষাতাত্ত্বিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র জন্ম, ওই বছরই বেগম রোকেয়া কর্তৃক কলকাতায় মুসলিম মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা, ১৯১৮ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সম্পাদনায় ‘সওগাত’ পত্রিকার প্রকাশ, ১৯২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা, ১৯২২ সালে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে কাজী নজরুল ইসলামের খ্যাতি অর্জন, ১৯২৫ সালে মূলত কুতুবুদ্দীন আহমদ-শামসুদ্দীন হুসায়ন-আবদুল হালীম-মুজফ্‌ফর আহমদ-কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ মুসলিম তরুণদের উদ্যোগে কমিউনিস্ট পার্টির পূর্বসূরি হিসেবে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজ্যান্টস পার্টি নির্মাণ, পরের বছরে কাজী আবদুল ওদুদ ও আবুল হুসেন-এর নেতৃত্বে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সূচনা, ১৯৩৫ সালে জসীম উদ্‌দীনের হিন্দু-মুসলিম সমপ্রীতি-সূচক কাব্য ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ লিখে ‘বেদ-ভাগবতের চেয়েও বেশি পবিত্র’ বলে দীনেশচন্দ্র সেনের কাছ থেকে অভিনন্দন লাভ, ১৯৩৭ সালে কৃষক প্রজা পার্টির অসামপ্রদায়িক নেতা ও বাঙালি জাতীয়তার প্রবক্তা ফজলুল হকের নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠন, ১৯৪৪-এ রেজাউল করীমের ‘বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলমান সমাজ’ লিখে মুসলিম মৌলবাদীদের মোকাবিলা, এ সবই ছিল সেই ঘটনা-শৃঙ্খলা যা পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে এক প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ ভাষা-জাতীয়তায় উদ্বুদ্ধ শ্রেণীর বিকাশ ঘটিয়েছে।... একে আমরা পুনর্জাগরণ বলে চিনতে পারি না কারণ এর যে ফলদায়ী প্রান্ত তা দেশভাগের দরুন আমাদের চোখের আড়ালেই থেকে গেছে।...”
এ বইয়ের পৃষ্ঠায়-পৃষ্ঠায় এমন অনেক পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন। পড়তে-পড়তে বুঝতে পারি, জাহিরুল হাসান কেবল একজন কৌতূহলী তথ্যান্বেষী বা অনুসন্ধিৎসু গবেষক নন, তিনি একজন গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মননশীল চিন্তাবিদ। তাঁর গবেষণা ও চিন্তাধারা আমাদের ক্রমাগত ঋদ্ধ করে চলুক ? এই কামনা করি।
sazzadqadir@gmail.com; sazzadqadir@rediffmail.com; sazzadqadir@yahoo.com; facebook.com/sazpa85

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন