শীতের রিক্ত রুক্ষ বিবর্ণতার পর আসে বসন্ত। আলোময় হয়ে ওঠে আকাশ, চারপাশে পুলক বয়ে আনে স্নিগ্ধ শীতল মৃদুমন্দ বাতাস। ফুলে-ফুলে পত্রপল্লবে বর্ণে-গন্ধে নতুন রূপে শোভিত প্রকৃতির বুকে জাগে রঙিন উচ্ছ্বাস, সেই সঙ্গে জীবনও মাতোয়ারা হয় প্রাণময় উৎসবে। বসন্ত তাই নতুনের প্রতীক, সে নতুন করে তোলে সব কিছু। যে দিকে চোখ যায় সে দিকেই নতুন জন্ম, নতুন নির্মাণ, নতুন বিকাশ। প্রকৃতি যেন সব দিকে জ্বালিয়ে দেয় সবুজ আলো, তাই সব দিকে খুলে যায় দিগন্তে উধাও পথ, আর শুরু হয় জীবনের হাসি-খুশি ছুটে চলা। ভাবি, কি শক্তি এই প্রকৃতির! আমাদের নিত্য দিনের একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীন জীবনে ? বিপর্যস্ত, জঞ্জালপূর্ণ, কটুগন্ধী পরিবেশে কি রূপান্তরই না ঘটিয়ে দেয়! উষ্ণ রোদ কিন্তু শীতল বাতাস ? এ এক ভারি আশ্চর্য জাদু। ইংরেজ কথাশিল্পী চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০) লিখেছেন, বসন্ত দুই ঋতু মিলিয়ে এক ঋতু ? এর আলোর উজ্জ্বলতা গ্রীষ্মের, এর স্নিগ্ধ ছায়া শীতের। এমন যুগল মাধুরীর কারণেই এ ঋতু এত মনোরম, এত উপভোগ্য। জারমান কবি রাইনের মারিয়া রিলকে (১৮৭৫-১৯২৬) লিখেছেন, বসন্ত এলে পৃথিবী আমোদিত আহলাদিত হয়ে ওঠে কবিতা জানা শিশুদের মতোই। আসলেই বসন্ত কবিতার ঋতু, কবিদের মুগ্ধ আতিশয্যের কাল। উত্তর ভারতের কবি কালিদাস (চতুর্থ শতক) বসন্তকে বলেছেন ‘সর্বাঙ্গসুন্দর’। এ ঋতুকে তিনি বর্ণনা করেছেন প্রেম কাম মিলন বিরহের নানা আবেগ ও অভিব্যক্তিতে। তাঁর ‘পুষ্পবাণবিলাস’ কাব্যে নায়কের আসন্ন বিচ্ছেদে, বিরহব্যথার আশঙ্কায় কাতর, এক নায়িকা বলেছে, ‘হে হৃদয়েশ্বর! বসন্ত দুয়ারে, আর তুমি ছেড়ে যাচ্ছো আমাকে?’ আরেক নায়িকা বসন্তকে বলেছে নির্দয়। কারণ তার আগমনে সে জর্জরিত হয়েছে বিরহজ্বালায়। ‘কোকিলের কুহু রব শুনে, পূর্ণচন্দ্রের কিরণচ্ছটা দেখে আর দখিনা বাতাসের নিষ্ঠুর আচরণে’ সে হয়ে পড়েছে মৃতপ্রায়। ‘ঋতুসংহার’ কাব্যেও কালিদাস বসন্ত অধীর ও উন্মনা করে দেয় প্রণয়ীদের। সে রূপের ডালি নিয়ে হাজির হয় প্রেমজ্বালায় তাদের পুড়িয়ে মারতে। গাছে-গাছে আম্রমুকুল, ভ্রমরদল, রক্তবর্ণ অশোক পুষ্পরাশি, কোকিলের কুহু তাদের করে রাখে উৎসুক ও উৎকণ্ঠিত, মিলনেও ফুরায় না সে আকুল অধীরতা। কিন্তু ভিন্ন রূপও আছে বসন্তের। সে রূপ এঁকেছেন বাংলার কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (আ. ১৫৪৭-?)। তাঁর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ (১৫৯৪-১৬০৬) কাব্যের দুঃখী নায়িকা ফুল্লরা বিলাপ করেছে, বসন্তে মদনজ্বালার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে দারিদ্র্য ও ক্ষুধার জ্বালা। সে জ্বালায় রাতে পাশে শোয়া প্রিয় পতিকে মনে হয় ক্রোশ খানেক দূরে। বাংলা ও বাঙালির জীবনে উভয়ই বাস্তব, তবুও বাংলার কবিরা জীবনের সকল দুঃখ ব্যথা পরাভবকে জয় করে গেয়েছেন ফুল্ল বসন্তের গান, বন্দনা করেছেন প্রেম প্রীতি ভালবাসার। প্রকৃতির বিকাশে তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন জীবনের ঐশ্বর্যকে।
মিথিলা’র কবি বিদ্যাপতি (আ. ১৩৮০-১৪৬০) বসন্তকে বলেছেন ‘ঋতুরাজ’। তাঁর কাব্যে পাই নায়িকার বসন্তযাপনের আবেগঘন বিবরণ:
... সেই কোকিল অব লাখ ডাকউ
লাখ উদয় করু চন্দা।
পাঁচ বাণ অব লাখ বাণ হোউ
মলয় পবন বহু মন্দা ॥...
বসন্তে এমন প্রেমানুভূতির প্রকাশ দেখি সমসাময়িক কবি শাহ মুহম্মদ সগীর (আ. ১৪-১৫ শতক)-এর ‘ইউসুফ জোলেখা’ কাব্যেও:
মাঘ হৈল পরকাশ কানন কুসুম হাস
শুভ ছিরি পঞ্চমী প্রকাশ।
মউলিত পুষ্পবন মদন মোহন ঘন
তা দেখিআ মোর মনোদাস ॥
বিকশিত আম জাম ভ্রমর ভ্রমএ কাম
সৌরভ ধারন্তি চতুর্দিশ।
মলয়া সমীর ধীর হৃদয় অন্তরে পীড়
বিরহিনীজন অহর্নিশ ॥
ফাগুনে চৌগুণ রীত নানা পুষ্প বিকশিত
যুবজন ফাগু বিভূষিত।
নবীন পরব বেশ সুরঙ্গ দুর্লভ দেশ
তরুলতা নবরঙ্গ হাস।
জুবক জুবতীগণ নানা বস্ত্র বিভূষণ
আভরণ বিচিত্র বিলাস ॥
চৈত্র হৈল সুললিত নানা পুষ্প বিকশিত
চম্পক চামেলী যূথী জাতী।
নাগেশ্বর শতবর্গ লবঙ্গ গুলাল স্বর্গ
আমোদিত প্রতি পাতি পাতি ॥...
মধ্যযুগের কবিদের ঋতু-বর্ণনা আমাদের মুগ্ধ করে এখনও। বুঝতে পারি কেবল কাব্যের শর্ত মেনে গৎবাঁধা বর্ণনা করেন নি তাঁরা, প্রতিটি ঋতুকে তুলে ধরেছেন ভিন্ন-ভিন্ন জীবন-প্রতীকে। সে অনুযায়ী বেশির ভাগ কবি বর্ষাকে বলেছেন ছয় ঋতুর রানী আর বসন্তকে বলেছেন রাজা। বর্ষা বিরহের প্রতীক, আর বসন্ত প্রেম-আনন্দের। চট্টগ্রামের কবি দৌলত উজির বাহরাম খান (১৬ শতক)-এর ‘লায়লী মজনু’ (১৫৪৩-১৫৫৩) কাব্যে সে রূপেই দেখি বসন্তকে:
... অলিকুল গুঞ্জে নওবত বাজে
কেহ নাদএ নাকাড়া ॥
কানন কুসুমিত নলিনী আমোদিত
চৌদিশ মন্দির স্থল।
বালেমু সুবদনী দোহঁ মিলি নিরজনি
খেলত রঙ্গে ধামাল ॥
এই দূতী মণ্ডল কো নাহি জানল
বিষম কাম হলাহল।
গোধর হরিহর অন্তর জরজর
কো নহি তিতল জ্বাল ॥
নাগর অতি নব তুরিতে মিলাওব
কেলি করাওব তছু সঙ্গে।
কি করব মারুত চঞ্চল পরভৃত
কি করব কঞ্চক অনঙ্গে ॥...
সতের শতকের মহাকবি আলাওল (১৬০৭-১৬৮০) ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে দীর্ঘ বর্ণনায় তুলে ধরেছেন তাঁর নায়ক-নায়িকার অধীর বসন্তযাপনের নানা ছবি। সেখান থেকে উদ্ধৃত করি কয়েক পঙ্ক্তি:
... মলয়া সমীর হৈলা কামের পদাতি।
মুকুলিত কৈল তবে বৃক্ষ বনস্পতি ॥
কুসুমিত কিংশুক সঘন বন লাল।
পুষ্পিত সুরঙ্গ মল্লি লবঙ্গ গুলাল ॥
ভ্রমরের ঝঙ্কার কোকিল কলরব।
শুনিতে যুবক মনে জাগে মনোভব ॥...
আদি ও মধ্যযুগের ঋতুকাব্যের উত্তরাধিকার সগৌরবে বহন করেছেন যুগসন্ধির কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮৫২-১৮৫৯)। বসন্তে প্রকৃতির ফুলে-ফুলে সেজে ওঠা, সেই সঙ্গে জীবনে পরিবর্তনের নানা ছবি এঁকেছেন তিনি। কিন্তু প্রেম মিলন অভিসার বিরহ ছাড়া কি এ ঋতুর সার্থকতা আছে কোনও? রঙ্গ-ব্যঙ্গে সিদ্ধহস্ত গুপ্ত-কবি বসন্তে সমব্যথী হয়েছেন বিরহিণী নারীর:
যদবধি প্রাণনাথ প্রবাসেতে রয়।
বসন্ত পীযূষ সম, বিষোপম হয় ॥
কোকিলের কুহুরবে কুহক লাগায়।
আমার হৃদয়ে আসি’ বিঁধে শেল প্রায় ॥
বকুল মধুর গন্ধে প্রমোদিত বন।
আকুল করিল তায় অভাগীর মন ॥
পলাশে বিলাস করে মালতীর লতা।
প্রবল করয়ে তার মনোমলিনতা ॥
নাগেশ্বর কেশর বেশর সম শোভা।
প্রজাপতি বসে ধরি’ মনোহারী প্রভা ॥
যেন কোন চতুর লম্পট জন শেষ।
ভুলায় ললনা-মন ধরি’ নানা বেশ ॥
পরে মধু ফুরাইলে, অমনি প্রস্থান।
যে দিকে সৌরভ ছোটে সে দিকে পলান ॥
সেই মত আমারে ভুলালে অরসিক।
আশাপথ চেয়ে আঁখি হোলো অনিমিখ ॥
একালে কবিতা ও গানে যুগ-যুগ ধরে কীর্তিত বসন্তের মহিমাকে আরও ঐশ্বর্যময় করেছেন রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, নজরুল সহ অনেক কবি। প্রকৃতির বুকে বসন্তকে নবজীবনের, উজ্জীবনের এবং পুনরুজ্জীবনের প্রতীক হিসেবে দেখেছেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “... বসন্তে... প্রাণের অজস্রতা, বিকাশের উৎসব। তখন আত্মদানের উচ্ছ্বাসে তরুলতা পাগল হইয়া উঠে; তখন আমাদের হিসাবের বোধমাত্র থাকে না; যেখানে দু’টো ফল ধরিবে সেখানে পঁচিশটা মুকুল ধরাইয়া বসে। মানুষই কি কেবল... আপনাকে ফুটাইবে না, ফলাইবে না, দান করিতে চাহিবে না; কেবলই কি ঘর নিকাইবে, বাসন মাজিবে; যাহাদের সে বালাই নাই, তাহারা বেলা চারটে পর্যন্ত পশমের গলাবন্ধ বুনিবে। আমরা কি এতই একান্ত মানুষ? আমরা কি বসন্তের নিগূঢ় রসসঞ্চার বিকশিত তরুলতাপুষ্পপল্লবের কেহই নই?...” দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানেও বসন্তে বিকাশের অজস্রতায় একাত্ম হওয়ার আহবান:
আয় রে বসন্ত তোর ও কিরণ পাখা তুলে।
নিয়ে আয় তোর কোকিল পাখির গানের পাতা গানের ফুলে।...
নিয়ে আয় তোর কুসুমরাশি,
তারার কিরণ চাঁদের হাসি,
মলয়ের ঢেউ নিয়ে আয় উড়িয়ে দে মোর এলোচুলে।...
তবে নগরজীবনের কৃত্রিমতায় ? যান্ত্রিকতায় বসন্ত যে তার প্রাচীন জৌলুস অনেকখানি হারিয়েছে তা-ও দুঃখ করে বলেছেন তাঁদের অনেকে। ভোগবাদী সমাজে বসন্ত-ও যে পণ্য হয়ে উঠেছে, একে ঘিরে যে ব্যবসা জমে উঠেছে ? সে দুঃখও করেছেন অনেকে। তাই শুনি কবির ব্যঙ্গোক্তি ? ‘বসন্ত কি আর্য আহা ? এসপ্ল্যানেডে আশ্চর্য জনতা!’ কারও রসিকতা আরও রঙ্গমধুর। তারাপদ রায় দেখেন ন্যাকা গাছে দখিনা ছোকরার সুড়সুড়ি, শিমুল শিরীষ ঢালে বিষ মনে মনে, কবিরা জড়িয়ে যায় লিরিকের লতায়। আসলে কবিতা কি? কিঞ্চিৎ রৌদ্রের সঙ্গে কতিপয় ফড়িংয়ের বাহার! তারপরও তো মানুষ ও প্রকৃতি এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা, তাই বসন্ত আসে, হৃদয়ের দু’কূল ছাপিয়ে ভালবাসার বন্যাও আসে কোন অলক্ষ্য প্রাণ-উৎস থেকে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘হৃদয়ের জগতেও একটা বসন্তের হাওয়া আছে ? সে কোন স্বর্গ থেকে আসে, গলির মোড় থেকে আসে না।’ আরও লিখেছেন, ‘বসন্ত ঋতুরই ধাতটা বায়ুপ্রধান ? সেই বায়ুর প্রকোপেই বিরহমিলনের প্রলাপটা প্রবল হয়ে ওঠে।’ এর রূপচ্ছবি তিনি দিয়েছেন কবিতায়:
... ফাগুন মাসে দখিন হতে হাওয়া
বকুল বনে মাতাল হয়ে এল।
বোল ধরেছে আমের বনে বনে,
ভ্রমরগুলো কে কার কথা শোনে,
গুনগুনিয়ে আপন মনে মনে
ঘুরে ঘুরে বেড়ায় এলোমেলো।... (‘হোরিখেলা’)
এ প্রাণমত্ততা বসন্তের ফাগুনবেলায় কি চৈত্রদিনেই শুধু সম্ভব। সে চৈত্রমাস কারও চোখে সর্বনাশ দেখার মাস। বুঝি তাই ছান্দসিক কবি আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪)-ও লেখেন:
ফাল্গুনে দেখিয়াছিনু স্বপ্নশীলা সখিরে আমার ?
তনুলতা লীলায়িয়া চলিয়াছে মন্দার-চয়নে,
শুভ্র বুকে পদ্মকলি শিহরায় সুগন্ধি-শয়নে,
অপাঙ্গে ভ্রূভঙ্গে খেলে অনঙ্গের বাঁকা তরবার, ?
স্তনতটে লোটে মালা, শ্রোণীমূলে মেখলা-ঝঙ্কার,
ওষ্ঠাধরে স্ফূর্তহাসি, রূপ-নেশা ঘূর্ণিত নয়নে,
স্নায়ুতে শিরায় নৃত্য, রক্তরেণু পুষ্প-প্রসাধনে,
চরণে অলক্ত-রেখা ? লেখা দূর দীর্ঘ অভিসার।...
ঐতিহ্যের কবি ফররুখ আহমদ (১৯৭৮-১৯৭৪) জীবনে তারুণ্যের উদ্ভাসন দেখেছেন বসন্তে, অনুভব করেছেন হৃদয়ের অনুরাগ-দীপ্ত জাগরণ:
‘বনানী সেজেছে সাকি ফুলের পেয়ালা নিয়ে হাতে’,
তুহিন শীতের শেষে দেখি আজ মুক্ত রূপ তার,
গাছে গাছে, ডালে ডালে তারুণ্যের জেগেছে জোয়ার;
জেগেছে ফুলের কুঁড়ি অরণ্যের মদিরা বিলাতে।
...
এখন তরুণী সেই প্রশাখার মত বাহু মেলে
একান্তে প্রতীক্ষমানা দয়িতের সাথে চায় মিল,
অরণ্যের শামাদানে প্রতীক্ষার মণিদীপ জ্বেলে
দেখে সে বিস্ময়ে চেয়ে সাজানো বনের মহফিল!
হৃদয়ের সব সুর, অনুরাগ কণ্ঠে তার ঢেলে
এ নির্জন বনছায় গেয়ে যায় প্রচ্ছন্ন কোকিল ॥ (‘ফাল্গুনে’)
বসন্ত সত্যিই বুঝি ফুলের পেয়ালা হাতে সাকী! কিন্তু কবিদের বসন্ত কি শুধুই প্রেম-কাম লীলা-বিলাস মগ্নতার কাল? জীবনের আর কোনও পরিসরে কি স্থান নেই তার? শিশুদের জীবনেও যে অনাবিল আনন্দের উৎস হয়ে আসে সে তা লিখেছেন কবি শেখ ফজলল করিম:
... এসো এসো ঋতুর রাজা
ধর মোদের স্নেহ তাজা রে
বল কোথায় বছর ভরে
ফুল ফোটালে কেমন করে হে
বাংলা মায়ের কানন ছেড়ে
সুখ পাও কি দুনিয়া ফিরে হে!
আমাদের বাগান কর আলা
কাল সকালে গাঁথব মালা যে।
ভোরেই এসো বনের রাজা
ফুল দিও ভাই তাজা তাজা যে।
sazzadqadir@gmail.com; sazzadqadir@rediffmail.com; sazzadqadir@yahoo.com; facebook.com/sazpa85
মিথিলা’র কবি বিদ্যাপতি (আ. ১৩৮০-১৪৬০) বসন্তকে বলেছেন ‘ঋতুরাজ’। তাঁর কাব্যে পাই নায়িকার বসন্তযাপনের আবেগঘন বিবরণ:
... সেই কোকিল অব লাখ ডাকউ
লাখ উদয় করু চন্দা।
পাঁচ বাণ অব লাখ বাণ হোউ
মলয় পবন বহু মন্দা ॥...
বসন্তে এমন প্রেমানুভূতির প্রকাশ দেখি সমসাময়িক কবি শাহ মুহম্মদ সগীর (আ. ১৪-১৫ শতক)-এর ‘ইউসুফ জোলেখা’ কাব্যেও:
মাঘ হৈল পরকাশ কানন কুসুম হাস
শুভ ছিরি পঞ্চমী প্রকাশ।
মউলিত পুষ্পবন মদন মোহন ঘন
তা দেখিআ মোর মনোদাস ॥
বিকশিত আম জাম ভ্রমর ভ্রমএ কাম
সৌরভ ধারন্তি চতুর্দিশ।
মলয়া সমীর ধীর হৃদয় অন্তরে পীড়
বিরহিনীজন অহর্নিশ ॥
ফাগুনে চৌগুণ রীত নানা পুষ্প বিকশিত
যুবজন ফাগু বিভূষিত।
নবীন পরব বেশ সুরঙ্গ দুর্লভ দেশ
তরুলতা নবরঙ্গ হাস।
জুবক জুবতীগণ নানা বস্ত্র বিভূষণ
আভরণ বিচিত্র বিলাস ॥
চৈত্র হৈল সুললিত নানা পুষ্প বিকশিত
চম্পক চামেলী যূথী জাতী।
নাগেশ্বর শতবর্গ লবঙ্গ গুলাল স্বর্গ
আমোদিত প্রতি পাতি পাতি ॥...
মধ্যযুগের কবিদের ঋতু-বর্ণনা আমাদের মুগ্ধ করে এখনও। বুঝতে পারি কেবল কাব্যের শর্ত মেনে গৎবাঁধা বর্ণনা করেন নি তাঁরা, প্রতিটি ঋতুকে তুলে ধরেছেন ভিন্ন-ভিন্ন জীবন-প্রতীকে। সে অনুযায়ী বেশির ভাগ কবি বর্ষাকে বলেছেন ছয় ঋতুর রানী আর বসন্তকে বলেছেন রাজা। বর্ষা বিরহের প্রতীক, আর বসন্ত প্রেম-আনন্দের। চট্টগ্রামের কবি দৌলত উজির বাহরাম খান (১৬ শতক)-এর ‘লায়লী মজনু’ (১৫৪৩-১৫৫৩) কাব্যে সে রূপেই দেখি বসন্তকে:
... অলিকুল গুঞ্জে নওবত বাজে
কেহ নাদএ নাকাড়া ॥
কানন কুসুমিত নলিনী আমোদিত
চৌদিশ মন্দির স্থল।
বালেমু সুবদনী দোহঁ মিলি নিরজনি
খেলত রঙ্গে ধামাল ॥
এই দূতী মণ্ডল কো নাহি জানল
বিষম কাম হলাহল।
গোধর হরিহর অন্তর জরজর
কো নহি তিতল জ্বাল ॥
নাগর অতি নব তুরিতে মিলাওব
কেলি করাওব তছু সঙ্গে।
কি করব মারুত চঞ্চল পরভৃত
কি করব কঞ্চক অনঙ্গে ॥...
সতের শতকের মহাকবি আলাওল (১৬০৭-১৬৮০) ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে দীর্ঘ বর্ণনায় তুলে ধরেছেন তাঁর নায়ক-নায়িকার অধীর বসন্তযাপনের নানা ছবি। সেখান থেকে উদ্ধৃত করি কয়েক পঙ্ক্তি:
... মলয়া সমীর হৈলা কামের পদাতি।
মুকুলিত কৈল তবে বৃক্ষ বনস্পতি ॥
কুসুমিত কিংশুক সঘন বন লাল।
পুষ্পিত সুরঙ্গ মল্লি লবঙ্গ গুলাল ॥
ভ্রমরের ঝঙ্কার কোকিল কলরব।
শুনিতে যুবক মনে জাগে মনোভব ॥...
আদি ও মধ্যযুগের ঋতুকাব্যের উত্তরাধিকার সগৌরবে বহন করেছেন যুগসন্ধির কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮৫২-১৮৫৯)। বসন্তে প্রকৃতির ফুলে-ফুলে সেজে ওঠা, সেই সঙ্গে জীবনে পরিবর্তনের নানা ছবি এঁকেছেন তিনি। কিন্তু প্রেম মিলন অভিসার বিরহ ছাড়া কি এ ঋতুর সার্থকতা আছে কোনও? রঙ্গ-ব্যঙ্গে সিদ্ধহস্ত গুপ্ত-কবি বসন্তে সমব্যথী হয়েছেন বিরহিণী নারীর:
যদবধি প্রাণনাথ প্রবাসেতে রয়।
বসন্ত পীযূষ সম, বিষোপম হয় ॥
কোকিলের কুহুরবে কুহক লাগায়।
আমার হৃদয়ে আসি’ বিঁধে শেল প্রায় ॥
বকুল মধুর গন্ধে প্রমোদিত বন।
আকুল করিল তায় অভাগীর মন ॥
পলাশে বিলাস করে মালতীর লতা।
প্রবল করয়ে তার মনোমলিনতা ॥
নাগেশ্বর কেশর বেশর সম শোভা।
প্রজাপতি বসে ধরি’ মনোহারী প্রভা ॥
যেন কোন চতুর লম্পট জন শেষ।
ভুলায় ললনা-মন ধরি’ নানা বেশ ॥
পরে মধু ফুরাইলে, অমনি প্রস্থান।
যে দিকে সৌরভ ছোটে সে দিকে পলান ॥
সেই মত আমারে ভুলালে অরসিক।
আশাপথ চেয়ে আঁখি হোলো অনিমিখ ॥
একালে কবিতা ও গানে যুগ-যুগ ধরে কীর্তিত বসন্তের মহিমাকে আরও ঐশ্বর্যময় করেছেন রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, নজরুল সহ অনেক কবি। প্রকৃতির বুকে বসন্তকে নবজীবনের, উজ্জীবনের এবং পুনরুজ্জীবনের প্রতীক হিসেবে দেখেছেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “... বসন্তে... প্রাণের অজস্রতা, বিকাশের উৎসব। তখন আত্মদানের উচ্ছ্বাসে তরুলতা পাগল হইয়া উঠে; তখন আমাদের হিসাবের বোধমাত্র থাকে না; যেখানে দু’টো ফল ধরিবে সেখানে পঁচিশটা মুকুল ধরাইয়া বসে। মানুষই কি কেবল... আপনাকে ফুটাইবে না, ফলাইবে না, দান করিতে চাহিবে না; কেবলই কি ঘর নিকাইবে, বাসন মাজিবে; যাহাদের সে বালাই নাই, তাহারা বেলা চারটে পর্যন্ত পশমের গলাবন্ধ বুনিবে। আমরা কি এতই একান্ত মানুষ? আমরা কি বসন্তের নিগূঢ় রসসঞ্চার বিকশিত তরুলতাপুষ্পপল্লবের কেহই নই?...” দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানেও বসন্তে বিকাশের অজস্রতায় একাত্ম হওয়ার আহবান:
আয় রে বসন্ত তোর ও কিরণ পাখা তুলে।
নিয়ে আয় তোর কোকিল পাখির গানের পাতা গানের ফুলে।...
নিয়ে আয় তোর কুসুমরাশি,
তারার কিরণ চাঁদের হাসি,
মলয়ের ঢেউ নিয়ে আয় উড়িয়ে দে মোর এলোচুলে।...
তবে নগরজীবনের কৃত্রিমতায় ? যান্ত্রিকতায় বসন্ত যে তার প্রাচীন জৌলুস অনেকখানি হারিয়েছে তা-ও দুঃখ করে বলেছেন তাঁদের অনেকে। ভোগবাদী সমাজে বসন্ত-ও যে পণ্য হয়ে উঠেছে, একে ঘিরে যে ব্যবসা জমে উঠেছে ? সে দুঃখও করেছেন অনেকে। তাই শুনি কবির ব্যঙ্গোক্তি ? ‘বসন্ত কি আর্য আহা ? এসপ্ল্যানেডে আশ্চর্য জনতা!’ কারও রসিকতা আরও রঙ্গমধুর। তারাপদ রায় দেখেন ন্যাকা গাছে দখিনা ছোকরার সুড়সুড়ি, শিমুল শিরীষ ঢালে বিষ মনে মনে, কবিরা জড়িয়ে যায় লিরিকের লতায়। আসলে কবিতা কি? কিঞ্চিৎ রৌদ্রের সঙ্গে কতিপয় ফড়িংয়ের বাহার! তারপরও তো মানুষ ও প্রকৃতি এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা, তাই বসন্ত আসে, হৃদয়ের দু’কূল ছাপিয়ে ভালবাসার বন্যাও আসে কোন অলক্ষ্য প্রাণ-উৎস থেকে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘হৃদয়ের জগতেও একটা বসন্তের হাওয়া আছে ? সে কোন স্বর্গ থেকে আসে, গলির মোড় থেকে আসে না।’ আরও লিখেছেন, ‘বসন্ত ঋতুরই ধাতটা বায়ুপ্রধান ? সেই বায়ুর প্রকোপেই বিরহমিলনের প্রলাপটা প্রবল হয়ে ওঠে।’ এর রূপচ্ছবি তিনি দিয়েছেন কবিতায়:
... ফাগুন মাসে দখিন হতে হাওয়া
বকুল বনে মাতাল হয়ে এল।
বোল ধরেছে আমের বনে বনে,
ভ্রমরগুলো কে কার কথা শোনে,
গুনগুনিয়ে আপন মনে মনে
ঘুরে ঘুরে বেড়ায় এলোমেলো।... (‘হোরিখেলা’)
এ প্রাণমত্ততা বসন্তের ফাগুনবেলায় কি চৈত্রদিনেই শুধু সম্ভব। সে চৈত্রমাস কারও চোখে সর্বনাশ দেখার মাস। বুঝি তাই ছান্দসিক কবি আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪)-ও লেখেন:
ফাল্গুনে দেখিয়াছিনু স্বপ্নশীলা সখিরে আমার ?
তনুলতা লীলায়িয়া চলিয়াছে মন্দার-চয়নে,
শুভ্র বুকে পদ্মকলি শিহরায় সুগন্ধি-শয়নে,
অপাঙ্গে ভ্রূভঙ্গে খেলে অনঙ্গের বাঁকা তরবার, ?
স্তনতটে লোটে মালা, শ্রোণীমূলে মেখলা-ঝঙ্কার,
ওষ্ঠাধরে স্ফূর্তহাসি, রূপ-নেশা ঘূর্ণিত নয়নে,
স্নায়ুতে শিরায় নৃত্য, রক্তরেণু পুষ্প-প্রসাধনে,
চরণে অলক্ত-রেখা ? লেখা দূর দীর্ঘ অভিসার।...
ঐতিহ্যের কবি ফররুখ আহমদ (১৯৭৮-১৯৭৪) জীবনে তারুণ্যের উদ্ভাসন দেখেছেন বসন্তে, অনুভব করেছেন হৃদয়ের অনুরাগ-দীপ্ত জাগরণ:
‘বনানী সেজেছে সাকি ফুলের পেয়ালা নিয়ে হাতে’,
তুহিন শীতের শেষে দেখি আজ মুক্ত রূপ তার,
গাছে গাছে, ডালে ডালে তারুণ্যের জেগেছে জোয়ার;
জেগেছে ফুলের কুঁড়ি অরণ্যের মদিরা বিলাতে।
...
এখন তরুণী সেই প্রশাখার মত বাহু মেলে
একান্তে প্রতীক্ষমানা দয়িতের সাথে চায় মিল,
অরণ্যের শামাদানে প্রতীক্ষার মণিদীপ জ্বেলে
দেখে সে বিস্ময়ে চেয়ে সাজানো বনের মহফিল!
হৃদয়ের সব সুর, অনুরাগ কণ্ঠে তার ঢেলে
এ নির্জন বনছায় গেয়ে যায় প্রচ্ছন্ন কোকিল ॥ (‘ফাল্গুনে’)
বসন্ত সত্যিই বুঝি ফুলের পেয়ালা হাতে সাকী! কিন্তু কবিদের বসন্ত কি শুধুই প্রেম-কাম লীলা-বিলাস মগ্নতার কাল? জীবনের আর কোনও পরিসরে কি স্থান নেই তার? শিশুদের জীবনেও যে অনাবিল আনন্দের উৎস হয়ে আসে সে তা লিখেছেন কবি শেখ ফজলল করিম:
... এসো এসো ঋতুর রাজা
ধর মোদের স্নেহ তাজা রে
বল কোথায় বছর ভরে
ফুল ফোটালে কেমন করে হে
বাংলা মায়ের কানন ছেড়ে
সুখ পাও কি দুনিয়া ফিরে হে!
আমাদের বাগান কর আলা
কাল সকালে গাঁথব মালা যে।
ভোরেই এসো বনের রাজা
ফুল দিও ভাই তাজা তাজা যে।
sazzadqadir@gmail.com; sazzadqadir@rediffmail.com; sazzadqadir@yahoo.com; facebook.com/sazpa85
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন