বুধবার, ৭ মার্চ, ২০১২

যেভাবে অক্ষরবন্দি হলো...

আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘রৌদ্রে প্রতিধ্বনি’ (১৯৭৬) প্রকাশের পর ‘মুক্তধারা’র প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা একদিন কথায়-কথায় বলেন, এখন থেকে বড়দের বই আর বের করবো না ভাবছি। জিজ্ঞেস করি, কারণটা কি? এত আয়োজন, উৎসাহ কি সব বৃথা যাবে? তিনি বলেন, প্রায় বৃথাই গেছে। লোকে আর বই কেনে না। বই পড়ার সেই অভ্যাসই আর নেই। বলি, তাহলে সে ধরনের বই-ই প্রকাশ করুন যা পাঠক সৃষ্টি করবে, পাঠাভ্যাস গড়ে তুলবে। চিত্তরঞ্জন সাহা বলেন, সে কাজই করছি। করছি একেবারে গোড়া থেকে। বড়দের বই ছেড়ে বের করছি ছোটদের বই। পড়ার অভ্যাস, নেশা গড়তে চাইছি ছোটদের। কেন চাইছি? যদি ওদের মধ্যে পাঠাভ্যাসটা গড়তে পারি তাহলে বড় হয়েও ওরা বই খুঁজবে, পড়বে। তাহলেই বুঝতে পারছেন?  আমরা পাবো ক্রেতা। আর সৃজনশীল সাহিত্য, সৎসাহিত্য পাবে পাঠক। তারপর বলেন, সবাইকে বলেছি ? আপনাকেও বলছি। আপনার পরের যে বইটা আমরা ছাপতে চাইছি সেটা ছোটদের বই। আমাদের একটা পাণ্ডুলিপি দিন।
    তাঁর চিন্তা সুদূরপ্রসারী, বক্তব্য যৌক্তিক, কিন্তু আমার জন্য হতাশাজনক। আমি কি আর ছোটদের জন্য লিখি? আমি বরং আমার বন্ধু মলয়কুমার ভৌমিক, হাফিজউদ্দিন আহমেদ ও আরও কেউ-কেউ যারা ‘কচিকাঁচার আসর’, ‘মুকুলের মহফিল’ বা ‘খেলাঘর’-এ লেখে তাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করি। ছোটবেলা থেকেই তো আমি ডেঁপো। বড়দের বই পড়ে-পড়ে পেকে গেছি একেবারে। সেই ১২-১৩ বছর বয়সেই সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯৬৬), ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় (১৯০৪-১৯৭৫), প্রভাবতী দেবী সরস্বতী (১৯০৫-১৯৭২) প্রমুখের গল্প-উপন্যাসের ধাঁচে আমিও রোমান্টিক ও ডিটেকটিভ গল্প-উপন্যাস লিখে ছোট-বড় খাতা ভরে ফেলেছি কত!
    তাহলে কি মুক্তধারা থেকে আর কোনও বই বেরোবে না আমার? হঠাৎ মনে পড়ে যায় স্কুল-জীবনে লেখা ও পত্রপত্রিকায় ছাপা হওয়া কিছু গল্পের কথা।
১৯৫৯ সালে, তখন আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি, পুজোর ছুটিতে কলকাতা থেকে টাঙ্গাইলে বাড়িতে মা-বাবা-ভাইয়ের কাছে বেড়াতে আসা খোকন দা (কবি তারাপদ রায়, ১৯৩৬-২০০৭)-র সঙ্গে পরিচয়। আমার পড়া ও লেখার নেশা দেখে একদিন তিনি বলেন, ইংরেজিটা ভাল করে শেখো। এ ভাষাটা না জানলে বিশ্ব-পৃথিবীর অনেক কিছুর খবর পাবে না ঠিকমতো। উন্নত সাহিত্য ও সাংবাদিকতার স্বাদ পাবে না, নতুন-নতুন চিন্তাধারা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির খোঁজ জানবে না।
এরপর থেকে শুরু হয় আমার ইংরেজি বই পড়ার চেষ্টা। সে বড় কঠিন ও দুঃসাধ্য কাজ। বন্দে আলী মিয়া (১৯০৬-১৯৭৯)-র উপন্যাস ‘তাসের ঘর’ পড়ে ফেলি এক বেলায়, কিন্তু আরস্কিন কল্ডওয়েল (১৯০৩-১৯৮৭)-এর ‘টোবাকো রোড’-এর পাঁচ পৃষ্ঠাও ওলটাতে পারি না সারা দিনে। খোকন দা বললেন, ডিটেকটিভ বই পড়ো। তাড়িয়ে-তাড়িয়ে পড়তে পারবে। তারপর অভ্যাস হয়ে যাবে ইংরেজি পড়াটা।
এই বলে পড়তে দেন আগাথা ক্রিসটি (১৮৯০-১৯৭৬)-র চারটি গোয়েন্দাগ্রন্থ। নিজেও যোগাড় করি আরলি স্ট্যানলি গার্ডনার (১৮৮৯-১৯৭০)-এর এক গাদা বই। এতে কাজ হয় অনেকটা, তবে সবটা নয়। শেষে ওই পড়তে-পড়তেই মাথায় বুদ্ধি আসে ? অনুবাদ করলে কেমন হয়! ইংরেজি শেখার চর্চাটাও হবে, সেই সঙ্গে আবার লেখালেখিও চলবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। শুরু করি সহজ ভাষায় লেখা শিশুতোষ গল্প অনুবাদ। হাতের কাছে পেয়ে যাই ন্যাথানিয়েল হথর্ন (১৮০৪-১৮৬৪)-এর ‘এ ওয়ান্ডার-বুক ফর গার্লস অ্যান্ড বয়স্‌’ । এ বইটি থেকেই প্রথম অনুবাদ করি হারকিউলিস-এর একটি গল্প। প্রথমে গলদঘর্ম অবস্থা, পরে সয়ে আসে আস্তে-আস্তে। তারপর বিভিন্ন রূপকথা-উপকথার সঙ্কলন থেকে এক-এক করে আরও অনেক গল্প ? তা ২০-২১টি হবে ? অনুবাদ করে ফেলি এক-দু’ বছরেই। সাহস করে কয়েকটি গল্প পাঠাই ঢাকার পত্রপত্রিকায়। সেগুলো ছাপা হয় সাপ্তাহিক জনতা, পাকিস্তানী খবর, পাক জমহুরিয়াত, দৈনিক আজাদের মুকুলের মহফিলে। ১৯৬২ সালে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর সওগাত, মোহাম্মদী, চিত্রালী ও অন্যান্য জাতীয় পত্রপত্রিকায় মৌলিক কবিতা-গল্প ছাপা হতে থাকায় আর উৎসাহ পাই নি অনুবাদে। তবে পুরনো খাতা থেকে ঘষে-মেজে কয়েকটি গল্প পাঠিয়েছিলাম বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। সেগুলোর একটি ছাপা হয়েছিল স্থানীয় পাক্ষিক হিতকরীতে। প্রথম অনুবাদ করা গল্পটি অবশ্য বহু বছর পর, ১৯৭৭-৭৮ সালে, ছাপা হয়েছিল ‘কিশোর বাংলা’য়।
ইংরেজি শিখতে চেয়ে অনুবাদ করা সেই সব গল্পের বেশির ভাগই হারিয়ে গেছে। সবগুলোর জন্য না হলেও বিশেষ করে একটি হারানো গল্পের জন্য দুঃখ করি এখনও। ‘তিন জন বামন বুড়ি’ নামের ওই গল্পটা ছাপা হয়েছিল ১৯৬৪-৬৫ সালের ঈদ সংখ্যা ‘মুকুলের মহফিল’-এ।
শেষ পর্যন্ত টাঙ্গাইলের বাড়িতে পুরনো বাঙপেটরা ঘেঁটে পেয়ে যাই গল্পগুলো। আশ্চর্যের ব্যাপার খুব বেশি মাজা-ঘষা না করেই সেগুলো সঙ্কলিত করি ‘তেপান্তর’ নামে। পৌঁছে দেই চিত্তরঞ্জন সাহা’র হাতে। তিনি পর-পর দু’টি সংস্করণের জন্য চুক্তি করেন সঙ্গে-সঙ্গে। ‘মুক্তধারা’র অন্যতম উপদেষ্টা তখন শিল্পী হাশেম খান। ভেবেছিলাম তিনিই হয়তো প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ করবেন বইটির, যেমন করেছিলেন আগের বই ‘রৌদ্রে প্রতিধ্বনি’র। ‘তেপান্তর’ ছাপা হয় ১৯৭৯ সালে। তখন আমি চীনের রাজধানী পেইচিং-এ, রেডিও পেইচিং-এর বাংলা বিভাগে ভাষা-বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত। সেখানেই ২৫ কপি বই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। দেখি, এর প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ করেছেন আইনুল হক মুন্না।
সেই থেকে শুরু আমার শিশুতোষ বই লেখা। ‘তেপান্তর’-এর পর এ পর্যন্ত ছোটদের জন্য লেখা ১৭টি বই বেরিয়েছে আমার।

sazzadqadir@gmail.com; sazzadqadir@rediffmail.com; sazzadqadir@yahoo.com; facebook.com/sazpa85



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন