বুধবার, ৭ মার্চ, ২০১২

প্রাণ-বাংলার কবি

করটিয়া’র সা’দত কলেজ (প্রতিষ্ঠা: জুলাই, ১৯২৬)-এ অধ্যয়ন (১৯৬২-৬৪) ও অধ্যাপনা (১৯৭২-৭৬)-র আগে, একদিন গিয়েছিলাম ১৯৫৭ সালে। তখন আমি বিন্দুবাসিনী হাই স্কুল (প্রতিষ্ঠা: ৩রা এপ্রিল, ১৮৮০)-এ ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। বয়স মোটে ১০ বছর। টাঙ্গাইল থেকে সাত সাত চোদ্দ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে রোদে পুড়ে করটিয়া গিয়ে আসার সে মহাউদ্যমে ক’জন মুরুব্বির সঙ্গী হয়েছিলাম কবি জসীম উদ্‌দীন ও শিল্পী জয়নুল আবেদিনকে দেখার উৎসাহে। কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন তখন লোকশিল্প-অনুরাগী তোফায়েল আহমেদ। তাঁর উদ্যোগে আয়োজন করা হয়েছিল লোকসংস্কৃতি উৎসবের। সেই উৎসবে যোগ দিতেই এসেছিলেন ওই দুই দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্ব ? আমাদের স্বপ্নের মানুষ। এখানে উল্লেখ করা দরকার, তোফায়েল আহমেদের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আমাদের প্রাচীন শিল্প’ প্রকাশিত হয় নি তখনও। এর কিছু-কিছু লেখা অবশ্য ছাপা হয়েছিল ঢাকার পত্রপত্রিকায়, কলেজের বার্ষিকীতে। বইটি বেরিয়েছিল ১৯৬০ সালে।
    উৎসবে ছিল গ্রামীণ পণ্য আর খেলাধুলার আয়োজন। কবি ও শিল্পী দু’জনেই লাঠিখেলা দেখে ও লাঠিয়ালদের সঙ্গে কথা বলে সময় কাটিয়েছেন অনেকক্ষণ। তাঁদের আগমন উপলক্ষে কলেজ মাঠের পশ্চিম পাশে, অধ্যক্ষের বাসভবনে ঢোকার মুখে,  বাঁশ বেত ছন দিনে কুঁড়েঘরের আকৃতিতে গড়া হয় এক মঞ্চ। এর উপরে বাঁশ-বেত দিয়ে লেখা ‘আমার বাড়ি আইস বন্ধু...’। ওই মঞ্চ ও লেখা এখনও আছে সম্ভবত। ১৯৮১ সালে একবার গিয়েছিলাম কলেজে বেড়াতে, তখন ওই শিল্পকীর্তিকে দেখেছিলাম অমনই।
    জসীম উদ্‌দীনকে কতখানিই বা চিনি তখন? মুরুব্বিদের মুখে ‘পল্লীকবি-পল্লীকবি’ নামডাক আর রেকর্ডে বা অনুষ্ঠানে তাঁর লেখা বা সংগৃহীত গান শুনি, পাঠ্য বাংলা বইয়ের পদ্যাংশে পড়ি ক’টি কবিতা ? এই তো আমার চেনাজানার চৌহদ্দি ওই বয়সে ও সময়ে। ‘রাখাল ছেলে’, ‘কবর’, ‘জননী’ ছাড়াও একটি কবিতা প্রিয় ছিল বিশেষভাবে। ‘নতুন কবিতা’ নামের সে কবিতার প্রথমাংশ এ রকম ?
    “রামধনুরে ধরতে পারি রঙের মায়ায়,
        ধরব না তা;
    বিজলী এনে ভরতে পারি রঙের খাঁচায়
        আনব না তা।
    আঁকশি দিয়ে পাড়তে পারি চাঁদের চুমো,
    ছড়ার নূপুর বাজিয়ে তোমায় করতে পারি ঘুমোঘুমো;
    পাতালপুরীর রাজকন্যে সাত মানিকের প্রদীপ জ্বালি’
    ঘুম ঘুমিয়ে ঘুমের দেশে ঘুমলী স্বপন হাসছে খালি,
    এসব কথা ছড়ায় গেঁথে বলতে পারি,
        বলব না তা,
    পাখির পাখায় লিখন তারে লিখতে পারি,
        লিখব না তা;
    লিখব আজি তাদের কথা, কথা যারা বলতে নারে,
    এক শ’ হাতে মারছে যাদের সমাজ-নীতি হাজার মারে।...”
    যারা কথা বলতে পারে না , তাদের কথা লিখতে হবে ? এ চিন্তা মাথায় ঢুকেছিল সেই তখনই। তারপর থেকে প্রতিষ্ঠাবিরোধীই থেকে গেছি, আর বদলে নিতে পারি নি নিজেকে। হাত কচলে, ঘাড় চুলকে, হালুয়া-রুটি খাওয়ার আসরে পারি নি যোগ দিতে।
    জসীম উদ্‌দীনের সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘নঙী-কাঁথার মাঠ’ (১৯২৯) ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ (১৯৩৪)-এর সঙ্গেও আমার পরিচয় পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে। কোনও শ্রেণীর এক বাংলা দ্রুতপঠন ছিল বিখ্যাত কাব্য, গীতিকা, উপন্যাস, নাটকের কাহিনীসংক্ষেপের সঙ্কলন। ‘আনোয়ারা’, ‘আবদুল্লাহ’, ‘বীরাঙ্গনা সখিনা’ প্রভৃতির পাশাপাশি ওই দু’টি কাব্যগ্রন্থের কাহিনীও স্থান পেয়েছিল তাতে। কাহিনীর সঙ্গে ছিল বিভিন্ন কাব্যাংশের উদ্ধৃতি। ফলে মূলের স্বাদও মিলতো কিছুটা। ওই বয়সে আমাকে মুগ্ধ করার জন্য ওইটুকুই ছিল যথেষ্ট। অষ্টম শ্রেণীতে আমাদের বাংলা দ্রুতপঠন ছিল জসীম উদ্‌দীনের ‘চলে মুসাফির’ (১৯৫২)। এ বইয়ের অসাধারণ গদ্য কি রকম মুগ্ধ মোহিত করেছিল আমাকে তা মনে পড়ে খুব। তাঁর শিশুতোষ গ্রন্থ ‘হাসু’ (১৯৩৮), ‘এক পয়সার বাঁশী’ (১৯৪৯) ও ‘ডালিমকুমার’ (১৯৫১) প্রথম পড়ার শিহরণ যেন অনুভব করি এখনও। রেডিওতে বহুবার শুনেছি ‘বেদের মেয়ে’ ও ‘মধুমালা’ (১৯৫১)-র নাট্যাভিনয়। সুযোগ পেলে আবারও শুনবো। ‘চিত্রালী’তে ধারাবাহিক ভাবে পড়েছি স্মৃতিকথা ‘ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়’। আর দুই খণ্ড ‘বাঙ্গালীর হাসির গল্প’ (১৯৬০, ১৯৬৪) তো প্রকাশের পর থেকেই রয়েছে আমার প্রিয় সংগ্রহের সামগ্রী। যত বার হারাই তত বার খুঁজে-খুঁজে কিনি।
    তিরিশের কবিদের দ্বারা আদ্যন্ত প্রভাবিত ষাটের বেশির ভাগ কবি-বন্ধুর কাছে জসীম উদ্‌দীন ও তাঁর কবিতা ছিল হাসি-তামাশার বিষয়। তাঁর ব্যক্তিজীবনের নানা কিছু নিয়ে রঙ্গব্যঙ্গ করতেন তাঁরা, আর এমন ভাবে তাঁর নামের আগে ‘পল্লীকবি’ বলতেন যেন তিনি বুঝি কোনও গ্রাম্য কবি। কিন্তু তা তো তিনি ছিলেন না। বাংলা একাডেমীর ‘চরিতাভিধান’-এ বলা হয়েছে, “গ্রামীণ জীবনের নিখুঁত চিত্র তাঁর কবিতায় কুশলতার সাথে অঙ্কিত। এ অঙ্কন রীতিতে আধুনিক শিল্প-চেতনার ছাপ সুস্পষ্ট।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কবিতা সংগ্রহ’-এ বলা হয়েছে, “রবীন্দ্র কাব্যধারার পাশে গ্রাম-বাংলার সহজ সরল প্রাকৃত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নাকে তিনি নতুন মহিমায় কাব্যমূল্য দান করেছেন। পল্লীজীবনের সহজ সতেজ শব্দ, উপমা এবং চিত্র সর্বদা তাঁর কাব্যের রূপকল্প নির্মাণ করেছে।...” জসীম উদ্‌দীনের কবিতার ছন্দও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে পেয়েছে ভিন্ন এক নাম ? ‘সহজ সমিল পল্লী পয়ার ছন্দ’। কিন্তু এ ছন্দে তাঁর কবি-উত্তরসূরি মেলে নি আজও। কয়েকজন ছড়াকার-কবির উল্লেখযোগ্য প্রয়াস থাকলেও এ ছন্দ অত কিছু সহজ নয়। এ ছন্দ এত আন্তরিকতায় স্পন্দিত যে কবি, কবিতা ও পাঠককে তা করে তোলে এক মন-প্রাণ। এই একত্ব সৃষ্টি মহৎ শিল্পী ছাড়া সম্ভব নয়।
    জসীম উদদীনকে সব সময়েই আমার মনে হয়েছে বাংলা ও বাঙালির নিজস্ব কবি। কথাটা অনেক আগেই বলেছেন কবিশেখর কালিদাস রায় (১৮৮৯-১৯৭৫), যিনি বিশেষ খ্যাত সমালোচক হিসেবেও, তবে সমপ্রতি পড়ার সুযোগ পেয়েছি আমি। কৌতূহলী পাঠকদের জন্য তাঁর সেই মূল্যায়নটি উদ্ধৃত করি এখানে:
“বাংলাদেশের এক-একজন কথাসাহিত্যিকের লেখনীতে এক-এক অংশের নরনারীর জীবন ও প্রাকৃতিক আবেষ্টনী ফুটেছে। হুগলী, হাওড়া জেলার অন্তরটা ফুটেছে শরৎচন্দ্রের রচনায় ? কোনও কবি এ অঞ্চলের অন্তরকে বাণীরূপ দেন নি। দেয়ার কথা ছিল কবিবর মোহিতলালের ? আরম্ভও করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এড়িয়ে গেলেন। নদীয়া, মুরশিদাবাদের কিয়দংশ, যশোহর, খুলনা, ২৪ পরগনার (আগেকার প্রেসিডেন্সি বিভাগ) অন্তরটা ফুটেছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মনোজ বসুর রচনায়। এ অঞ্চলের কবি যতীন্দ্রমোহন। ভাগীরথীতীরের বর্ণহিন্দু সমাজের বাণীরূপ লাভ করেছে বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের রচনায়। এই অঞ্চলের কবি কিরণধন চট্টোপাধ্যায়। আর রাঢ়দেশের অন্তরের অন্তস্তল পর্যন্ত নিঃশেষভাবে রূপ গ্রহণ করেছে তারাশঙ্করের রচনায় এবং কতকটা সরোজকুমারের রচনায়। এ অঞ্চলের কবি কুমুদরঞ্জন। এ হিসাবে পূর্ববঙ্গের কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আর ও অঞ্চলের কবি জসীমউদ্‌দীন।”
এ ভাবে জসীম উদ্‌দীনকে আমরা দেখতে পারি নি আজও। বস্তুত তাঁর কাব্যমহিমার মূল্যায়ন- বিশ্লেষণ হয় নি প্রাণ-বাংলার কবি হিসেবে। এমনিতে নানা দায়ে ও স্বার্থে নামডাক করলেও প্রকৃত সমাদরও করা হয় নি তাঁকে। বাংলা একাডেমীর সাহিত্য পুরস্কার পান নি তিনি। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাংলা একাডেমী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও নজরুলকেও সম্মান জানায় নি। এ ঐতিহ্য সে পালন করে আসছে বরাবরই। কিন্তু তাতে কি আসে যায় শিল্পী-সাহিত্যিকদের? পুরস্কারের গৌরব নয়, সৃষ্টির সৌরভই তাঁদের জীবনকে করে রাখে কীর্তিধন্য।
সবশেষে ‘নঙী-কাঁথার মাঠ’ থেকে উদ্ধার করি আমার প্রিয় কয়েক পঙ্‌ক্তি:
    “... কেউ বা বলে আদ্যিকালের এই গাঁ’র এক চাষী,
    ওই গাঁ’র এক মেয়ের প্রেমে গলায় পরে ফাঁসি;
    এ পথ দিয়ে একলা মনে চলছিল ওই গাঁয়ে,
    ও গাঁ’র মেয়ে আসছিল সে নূপুর-পরা পায়ে!
    এইখানেতে এসে তারা পথ হারায়ে হায়,
    জলীর বিলে ঘুমিয়ে আছে জল-কুমুদীর গায়।
    কেই বা জানে হয়তো তাদের মালা হতেই খসি’
    শাপলা-লতা মেলছে পরাগ জলের উপর বসি’।
    মাঠের মাঝে জলীর বিলের জোলো রঙের টিপ,
    জ্বলছে যেন এ গাঁ’র ও গাঁ’র বিরহেরই দীপ।
    বুকে তাহার এ গাঁ’র ও গাঁ’র হরেক রঙের পাখি,
    মিলায় সেথা নতুন জগৎ নানান সুরে ডাকি’।
    সন্ধ্যা হলে এ গাঁ’র পাখি এ গাঁও পানে ধায়,
    ও গাঁ’র পাখি ও গাঁও চলে বনের কাজল-ছায়।...”
sazzadqadir@gmail.com; sazzadqadir@rediffmail.com; sazzadqadir@yahoo.com; facebook.com/sazpa85

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন