রবিবার, ৪ মার্চ, ২০১২

করাল গ্রাসের কবলে

কত পুরনো আমাদের এই ঢাকা নামের জনপদটি? গবেষকরা বলেন, দুই সহস্রক ছুঁয়েছে এর বয়স। সাত শতকে যে বসতি ছিল এখানে সে প্রমাণ মিলেছে অনেক আগেই। সামপ্রতিক তথ্যানুসন্ধানে, উয়ারি বটেশ্বরের খননে ও অন্যান্য নিদর্শন থেকে আমরা পেয়েছি এ অঞ্চলের দীর্ঘ জন-ইতিহাস। সেই শতকে কামরূপের বৌদ্ধ রাজাদের অধীনে ছিল ঢাকা, তারপর ছিল পাল রাজাদের অধীনে। পাল রাজারাও ছিলেন বৌদ্ধ। নয় শতকে পালাবদল ঘটে ক্ষমতার। ফলে ঢাকা আসে হিন্দু সেন রাজাদের অধীনে। এই বংশের রাজা বল্লাল সেন (?-১১৭৯) এখানে নির্মাণ করেন ঢাকেশ্বরী মন্দির। ঢাকা নামের উৎপত্তি সম্ভবত ওই মন্দিরের নাম থেকেই। ঢাকেশ্বরী মন্দির ঘিরেই ক্রমশ গড়ে ওঠে ঢাকা শহর। শহর বলতে অবশ্য কয়েকটি বাজার তখন ? কুমারটুলি, গোয়াল নগর, তাঁতিবাজার, পটুয়াটুলি, বেনিয়া নগর, লক্ষ্মীবাজার, শাঁখারীবাজার প্রভৃতি।  ঢাকা ও এর আশপাশের অঞ্চলের ‘বাঙ্গালা’ নামে পরিচিতিও সেই তখন থেকেই শুরু বলে ধারণা করা হয়।
    সেন রাজাদের পর ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় সুলতানদের শাসন। ওই সুলতানদের অনেকে ছিলেন স্বাধীন, অনেকে ছিলেন দিল্লি থেকে পাঠানো প্রশাসক। তাঁদের সময়ও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে ঢাকা। ১৪৫৭ সালে নির্মিত মসজিদ এখনও আছে এ শহরে। ১৬০৮ সালে মুগলদের অধিকারে আসে ঢাকা। রাজমহল থেকে রাজধানী সরিয়ে এনে ঢাকাকে তাঁরা গড়ে তোলেন দুর্গ-শহর হিসেবে। এর প্রথম প্রশাসক ছিলেন সুবাদার ইসলাম খাঁ। মুগল সম্রাট জাহাঙ্গিরের নাম অনুসারে তিনি ঢাকার নাম রাখেন জাহাঙ্গিরনগর। তবে জাহাঙ্গিরের মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে বাতিল হয় এ নাম। ১৬০৮ সালেই আবার বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে স্থানান্তরিত হয় রাজমহলে, কিন্তু ১৬৬০ সালে ফিরে আসে আবার। ১৭১৭ সালে নবাবি আমলে ঢাকা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত হয় মুরশিদাবাদে।
    ঢাকার সত্যিকারের সমৃদ্ধি আসে মুগল সেনাপতি শায়েস্তা খাঁ’র আমলে। তখন শহরের আয়তন দাঁড়ায় ১৯ঢ১৩ কিলোমিটার, আর জনসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় এক লাখ। বৃটিশ ইস্ট ইনডিয়া কোমপানি এ অঞ্চলের দিওয়ানি (রাজস্ব আদায়ের অধিকার) পায় ১৭৬৫ সালে, পরে শাসনের অধিকার পায় ১৭৯৩ সালে। ওই বছর বাংলা, বিহার ও ওড়িশা’র কর্তৃত্ব ত্যাগে বাধ্য করা হয় বাংলার নবাবদের। কোমপানি শাসনে কলকাতা’র প্রাধান্য থাকায় ঢাকা’র জনসংখ্যা হ্রাস পায় অনেক। কিছু কাল পরে অবশ্য নানারকম উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে ঢাকায়। মুগল সেনাপতিদের অনুসরণে বৃটিশ ও বাঙালি সৈন্যদের জন্য গড়ে ওঠে ছাউনি-নিবাস। পিলখানা, তোপখানা প্রভৃতি নামে রয়ে গেছে সে ইতিহাস। ঢাকা মিউনিসিপাল শহর হয় ১৮৬৪ সালে। বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা চালু হয় ১৮৭৮ সালে। এর চার বছর আগে, ১৮৭৪ সালে, চালু হয়  আধুনিক পৌর পানি সরবরাহ ব্যবস্থা। তারপর এই ১৩৭ বছর পর কি অবস্থা সেই পানি ব্যবস্থার?
    ঢাকাকে দুর্গ-শহর হিসেবে মুগলদের বেছে নেয়ার বিশেষ কারণ ছিল বুড়িগঙ্গা নদীর বিচিত্র জোয়ার-ভাটা। কারণ তাঁরা চাইছিলেন এমন এক নৌশক্তি গড়ে তুলতে যা দক্ষিণাঞ্চলের মগ, পরতুগিজ ও অন্যান্য জলদস্যুদের দমনে নিতে পারে কার্যকর ব্যবস্থা। ঢাকার চারপাশের নৌপথ সেদিক দিয়ে ছিল সর্বতোভাবে উপযোগী। ওই সব নৌপথের সঙ্গে ঢাকার ভেতরকার বিল-ঝিলও ছিল যুক্ত। তারপরও ব্যাপকভাবে চলাচলের সুবিধা যাতে হয় সেজন্য বেশ কিছু খাল খনন করে পুরো ঢাকার পানি-ব্যবস্থাকে পরস্পর-যুক্ত করেছিলেন মুগল প্রশাসকেরা। এসব ছিল ঢাকার প্রাণপ্রবাহ। এজন্য বর্ষাকালের মতো শুষ্ক মওসুমেও নৌপথে চলাচল ছিল স্বাভাবিক। সেসব খাল-বিল ভরাট করে রুদ্ধ করা হয়েছে প্রবাহ, এখন নদীগুলো বিপন্ন, ধ্বংসের মুখে।
    অথচ রাজধানী ঢাকার অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে চারপাশে চারটি নদী ? উত্তরে টঙ্গি খাল, পুবে বালু, দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা ও পশ্চিমে তুরাগ। আমাদের খাবার পানি, নানা ধরনের মাছ, নৌ চলাচল, পয়ঃপ্রণালী প্রভৃতির সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পর্কিত এই নদীগুলি। কিন্তু গত শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রায় অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে ওঠায় এ শহর পরিবেশগত ভারসাম্য শুধু বিনষ্ট করে নি, রীতিমতো বিপর্যয়ই ঘটিয়ে ফেলেছে এখন। এ বিপর্যয়ের প্রধান শিকার হয়েছে নদী, বিল-ঝিল, খাল, জলাভূমি। জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি, শিল্প-কারখানার বর্জ্য, যন্ত্রপাতি-বাহনের জঞ্জাল, পৌর আবর্জনা ইত্যাদি এর জন্য বিশেষভাবে দায়ী। এই ব্যাপক নদীদূষণ গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করে চলেছে আমাদের প্রাণব্যবস্থার ওপর। এ সব নদীর পানি আর ব্যবহার-উপযোগী নয়। সেই টলটলে স্বচ্ছ পানি আর নেই। মুখে দিলে সঙ্গে-সঙ্গে ওয়াক করতে হয় ?? এমনই বিস্বাদ। এর রঙ মিশমিশে আলকাতরার মতো। আর এমন দুর্গন্ধ যে নাকে রুমাল না দিয়ে থাকার উপায় নেই। শ্যাওলা জমে বদ্ধ এ পানিতে কোনও জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না। এর ওপর সবসময় তেলতেলে পদার্থ দেখা যায় ভেসে থাকতে।
    গত এক দশকে ব্যাপক শিল্পায়ন ঘটেছে আমাদের রাজধানীর কয়েকটি এলাকায়। এই সময়ের মধ্যে হাজারিবাগ, তেজগাঁও ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা বাঁধ এলাকায় নতুন কারখানা স্থাপিত হয়েছে সাত হাজারেরও বেশি। এগুলোর মধ্যে রঙ ও চামড়ার কারখানার বর্জ্য মারাত্মক দূষণের জন্য বেশি দায়ী। দূষণের পাশাপাশি রয়েছে নদীগ্রাস। খাল বিল ঝিল জলাভূমি যেভাবে করাল গ্রাসের কবলে পড়েছে, নদীও পড়েছে সেভাবেই। এই দূষণ ও গ্রাস ঠেকাতে সেই উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে কত আইন-কানুন বিধিবিধান আদেশ-নির্দেশই না জারি করা হয়েছে ?? কিন্তু কে শোনে কার কথা! আর শুনবেই বা কেন? এসব দেখার ? দেখভাল করার কেউ আছে কি?
    বছর তিনেক আগে, ২০০৯ সালের ৮ই এপ্রিল, পরিবেশন দূষণ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে যা উল্লেখ করা হয়েছিল এখনও তা সত্য হয়ে আছে হুবহু। এই দু’ বছরে সরকার অনেক কিছু করেছে, আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে ভূমিকাও রেখেছে ? কিন্তু উন্নতি হয়েছে কতখানি কি?
    প্রতিবেদনটি এ রকম:
   “The government over the years has allowed industrialists to pollute the rivers, canals and wetlands in and around the city  to such an extent that surface water turned pitch black in several spots. Pollution has set in on the Buriganga, Shitalakhya and Balu rivers and made it almost impossible to treat the water. The water and Sewerage Authority  (wasa), is supplying stinky water by purifying it with cholorine ammonia sulfate. But most of the industrialists have defeid the directive and the government also did not take action against any of the violators. Even the department of environment (DoE) does not know much about it. Besides industry generated liquid and solid waste, most of the human excreta directly goes down the rivers through underground pipelines as nearly 70 percent houses are not connected to the excrete treatment plant. Waste from these industries is connected with the sewerage system that directly goes into tha rivers around the city. In fact, the rivers have become a dumping ground of all kinds of solid, liquid, and chemical waste of bank side population.”
    এরপর আর কোনও মন্তব্য করার প্রয়োজন দেখছি না। ঢাকার নদী নয়, খোদ ঢাকাই তো পড়েছে করাল গ্রাসের কবলে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন