রবিবার, ৪ মার্চ, ২০১২

নগরে বইয়ের হাট কোথাও

আমার যে স্বভাব তাতে মেলায় গিয়ে যুত হয় না বই কেনায়। নেড়েচেড়ে দেখবো, দোকানির সঙ্গে দু’ চার কথা বলবো, খোঁজখবর নেবো ? তারপরই না কিনবো পছন্দের বইগুলো। কিন্তু তেমনটি হওয়ার যো নেই মেলায়। সেখানে আছে ভিড়, ঘেষাঘেষি, ঠেলাঠেলি, ধুলো, আর দোকানির ফুরসত নেই কথা বলার। এজন্য মেলায় প্রথম দিকে কয়েক বার চক্কর দিয়ে মনে-মনে বেছে রাখি বই, তারপর শেষের দিকে দু’ দিনে দু’ চক্কর দিয়েই কিনে ফেলি সব বই। এ কায়দাটা নতুন বইয়ের বেলায় খাটলেও পুরনো বইয়ের বেলায় না-ও খাটতে পারে। এবার একটি বইয়ের শেষ কপি পাই একেবারে শেষ মুহূর্তে, আরেকটি বই নেড়েচেড়ে দেখে রেখে এসে পরে পাই নি আর।
    চক্কর দেয়া নিয়েও আছে সমস্যা। হেঁটে চলে ঘুরতে ফিরতে গায়ের ওপর এসে পড়ে লোকজন। ধাক্কাধাক্কি করে। প্রবীণ বা বর্ষীয়ান বলে রেহাই দেয় না ? আশপাশ থেকেই চেঁচিয়ে খিস্তিখেউড় করে, অশালীন অঙ্গভঙ্গি করে মাতে হি-হি হো-হোতে, মুখের ওপর ছুড়ে দেয় বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়া। চেনাজানা থাকলে যেটুকু সমীহ মেলে তা জোটে না আমার বেলায়। এর কারণ অন্য কিছু নয়, সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে জাতীয় পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করলেও ফাটাফাটি কিছু লিখে উঠতে না পারায় আমি তেমন পরিচিত নই লেখক-সাংবাদিক জগতে। কিছু পাঠক আমার লেখা বা নাম জানলেও তাঁদের অনেকেই কখনও দেখেন নি আমাকে। হৃদব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে ১৯৯৩ সাল থেকে আমার জীবন কাটে কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। বাইরে তেমন বেরোই না, আড্ডা-অনুষ্ঠানে যাই না। এজন্য অনেকেই চেহারায় চেনেন না আমাকে। এই অপরিচয়ের কারণে মেলায় স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াবার সুখ থাকলেও বিব্রত হওয়ার, অস্বস্তিতে ভোগার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় প্রায়ই। সেদিন এক চক্কর দিয়ে বসেছি ক্যানটিনের খোলা জায়গাটায়। সামনে টেবিলে কয়েকজন বয়স্ক মহিলা। ও পাশের টেবিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক’জন শিক্ষক। এর মধ্যে তিন যুবক এসে বসে পিছনের টেবিলে। বসেই কাঁচা খিস্তি, তারপর আমাদের চেনাজানা কবিদের নাম ধরে-ধরে সমস্বরে গুষ্ঠি উদ্ধার শুরু করে তারা। কথায় বোঝা যায় সামপ্রতিক কবিতার রাজ্যে তাদের দাপট আছে যথেষ্ট, পত্রপত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে নিয়মিত নানা চোটপাট চলে তাদের। কিন্তু ওই তিন তালেবর আগাগোড়া যে ভাষায় কথা বলে গেল তাতে কবি-লেখক কিছু ভাবতে পারি না তাদের, নিতান্তই ইতর মাসতান ভাবি। তাজ্জব ব্যাপার হলো, এত সব গলগলে খেউড় শুনেও কোনও প্রতিক্রিয়া নেই মহিলাদের, শিক্ষকদের। জিজ্ঞেস করে জানলাম, এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তাঁরা। এখন আর অমার্জিত বোলচাল ও অঙ্গভঙ্গিতে কিছু মনে করেন না, গাসহা হয়ে গেছে সব। তবে আমার হয় নি, হবেও না।
    মেলায় বই কেনার সমস্যার কথা বলছিলাম। এ সমস্যা আছে আরও। বড় সমস্যা বইয়ের খোঁজ পাওয়ার। কোন লেখকের কোন বই কোন প্রকাশক ছেপেছেন ? এই মূল্যবান খোঁজটাই পাওয়া যায় না সহজে। মেলার সময়টায় দু’একটি পত্রিকায় কিছু বিজ্ঞাপন ছাপা হয় সেগুলোর ওপর নির্ভর করা যায় না। টিভি চ্যানেলগুলোর ক্যামেরাও ঘোরাঘুরি করে মেলায়, তাতেও ধরা পড়ে না তেমন কিছু। এর কারণও আছে। আত্মমর্যাদাবান লেখকেরা সাংবাদিক বা ক্যামেরার সামনে কখনও নিজে থেকে যাবেন না, আবার তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের সময় ও সুযোগ হয়ে ওঠে না সাংবাদিক-প্রযোজকদের। এ অবস্থায় তথ্যকেন্দ্র পরিবেশিত ভুলে ভরা নামের তালিকা আর চেনামুখদের নিয়ে দায়সারা কাজই দেখা যায় মেলার খবরাখবরে। নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে কিছু মিত্রতোষণ ও স্বজনপ্রীতি যে থাকবেই তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে কোনও-কোনও পত্রিকা থেকে এমন নবিশদেরও পাঠানো হয় যাঁদের লেখক বা বই সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। আমি এমন একজনকে এবার চিনেছি যিনি রশীদ করীমকে ‘রশিদুল করিম’ লেখেন, মোহন রায়হানের নাম শোনেন নি, জিজ্ঞেস করলে বলেন ‘মোহন খানের নাম জানি’। এই নবিশের অনেক কীর্তির একটি ? নজরুল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হুমায়ূন আজাদ স্মরণসভার খবরটি দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেন নি তিনি।
এ ছাড়া আছে আরও নানারকম ধান্দাবাজি। ধান্দা? শুনে চোখ কপালে তুলবেন অনেকে। বইমেলাতেও ধান্দাবাজি চলে? চলে। ক’ দিন না যেতেই স্বঘোষিত সম্পাদক সঙ্কলক অনুসন্ধানী জরিপকারী হাজির হয়ে যান মেলাতে। কিছু প্রকাশক-লেখককে ‘বাবা-সোনা’ বলে আর অন্যদের ঘাড় ভেঙে তাঁরা বের করেন মেলায় সেরা ২৫ বা ৫০ বা ১০০ বইয়ের বাহারি তালিকা। বিনা মূল্যে বিলিয়ে দেয়া ও সব তালিকায় নিজেদের এক বা একাধিক বইয়ের নামও ঢুকিয়ে দেন তাঁরা। কিছু পত্রিকাও করে এ কাজটি। প্রশ্ন হলো: এই কয়েক হাজার নতুন বই কারা কখন পড়ে কিভাবে কি বিচার করলেন? এটা যদি ধান্দা না হয় তাহলে ধান্দা কি? এ ধান্দার নাম প পি চু অর্থাৎ পরস্পর পিঠ চুলকানি। এ ধান্দাবাজদের সমিতিও আছে। তার নাম ? প পি চু স। পরস্পর পিঠ চুলকানি সমিতি। এ সমিতির কারণে দেশের অনেক লেখক ও তাঁদের অনেক বইয়ের খবর  পান না অনেক পাঠক। এ পরিস্থিতির শিকার হন বহু কৃতী লেখক, আর বঞ্চিত হন বহু পিপাসু পাঠক।
    সবার উপরে আছে মেলায় নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থা। শুরু থেকেই ছিল এ সব। এক পর্যায়ে রীতিমতো হয়ে পড়েছিল রীতিমতো ঘাপলা-গ্যানজাম। সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন যথেষ্ট কঠোরতা অবলম্বন করে যে সৌষ্ঠব শৃঙ্খলা এনেছিলেন এবার ধস নেমেছে তাতে। তবে পত্রপত্রিকাও এবার প্রথমবারের মতো হাত খুলে লিখেছে মেলার যত ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে। অনেক প্রকাশকও মন খুলে বলেছেন নানা সমস্যার কথা। মেলা নিয়ে হীন রাজনীতি, নগ্ন দলীয়করণ সহ অনেক বিষয়ই উঠে এসেছে সে সব আলোচনা-সমালোচনায়। প্রকাশক নয় এমন অনেক প্রতিষ্ঠান সংগঠন সমিতি সংস্থাকে স্টল বরাদ্দ দেয়া নিয়েই কথা হয়েছে বেশি। সে সব সমালোচনা মেলাকে ছাড়িয়ে বাংলা একাডেমীর সামপ্রতিক রাজনৈতিক নিয়োগ পর্যন্ত গড়িয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
    এবারের মেলায় বিশেষ উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা-কীর্তি রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতজন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মূর্ধন্য প্রকাশনী কর্তৃক ‘রবীন্দ্রস্মারক গ্রন্থমালা’র ১৫১টি বইয়ের প্রকাশ। এ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রচার-প্রকাশমাধ্যমে যেমন যথোচিত গুরুত্ব পায় নি, অন্যদিকে বাংলা একাডেমী-ও এমন একটি প্রকাশনাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে একটি সিঙ্গল স্টল বরাদ্দ দিয়ে কর্তব্য পালন করেছে। তবে যাঁদের ডাবল-ট্রিপল স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তাঁদের বেশির ভাগেরই দু’-তিনটিও উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা পাওয়া যায় নি এ বছর।
    ঐতিহ্য নিয়ে আমরা গর্ব-গৌরব করি, তবে কখনও সে ঐতিহ্য বোঝা হয়েও দাঁড়ায়। অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র ঐতিহ্য বাংলা একাডেমীর জন্য তেমন বোঝা হয়ে উঠেছে কিনা তা ভেবে দেখার সময় এসেছে এখন। কারণ বাংলা একাডেমী তো আসলে একটি একাডেমী। এর কাজ তো আসলে একাডেমিক। এখানে তেমন মানুষ তেমন কাজ চাই। সে সব রেখে গ্রন্থ প্রকাশনা-ব্যবসায় জড়িয়ে একে আদর্শ ও লক্ষ্য থেকে চ্যুত করা ঠিক হবে কি? গ্রন্থমেলার কাজ তো আসলে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের। প্রতি বছর সুশৃঙ্খল ‘ঢাকা বইমেলা’র আয়োজন করে এ প্রতিষ্ঠানটি। এবার কেন করে নি তা বোঝা গেল না। মাহমুদুর রহমান (যিনি লেখক হিসেবে ‘আনু মাহমুদ’ নামে পরিচিত) যখন পরিচালক ছিলেন তখন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সুনাম সুযশ ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের বাইরেও। এখন পরিচালক আমাদের সকলের প্রিয় কবি রফিক আজাদ। তাঁর কাছেও আমাদের প্রত্যাশা বেশি। তিনি ‘ঢাকা বইমেলা’র গৌরব ফিরিয়ে আনবেন এমনটাই চাই আমরা।
    তবে সবচেয়ে ভাল হয় যদি এই নগরে আমরা পাই একটি বইয়ের হাট। শুক্র ও শনি দু’দিন সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সে হাট বসতে পারে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, পান্থকুঞ্জ, ধানমণ্ডি পার্ক বা অন্য কোথাও। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের নেতৃত্বে এ আয়োজনে উদ্যোগী হতে পারে বাংলা একাডেমী, শিশু একাডেমী, ইসলামী ফাউন্ডেশন, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর সহ সরকারি / স্বায়ত্তশাসিত সকল প্রতিষ্ঠান ? যারা প্রকাশনা কার্যক্রমে জড়িত। আমি তো মনে করি কেবল সরকারের মুখাপেক্ষী থাকাও ঠিক নয়। বেসরকারি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসতে পারেন এ মহতী কাজে। বইয়ের হাটের একটি স্থায়ী রূপ দেয়াও হয়তো সম্ভব হবে একদিন।

sazzadqadir@gmail.com; sazzadqadir@rediffmail.com; sazzadqadir@yahoo.com; facebook.com/sazpa85

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন