রবিবার, ৪ মার্চ, ২০১২

রিস্টার্ট ঢাকা

ঢাকার কি হবে? জীবন যাপনের সমস্যা, নাগরিক সুবিধার অভাব তীব্র হয়ে উঠছে দিনের পর দিন ? এ অবস্থায় কি ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে আমাদের এই রাজধানী শহরের জন্য?  বাংলার বিলুপ্ত / পরিত্যক্ত রাজধানী কর্ণসুবর্ণ, চন্দ্রকেতুগড়, পুণ্ড্রবর্দ্ধন, নালন্দা, বিক্রমশীল, সোমপুর, সাগরদিঘি, নবদ্বীপ, বিক্রমপুর, গৌড়, পাণ্ডুয়া, সোনারগাঁও, মুঙ্গের, মুরশিদাবাদ, রাজমহল প্রভৃতির তালিকায় একদিন স্থান হবে ঢাকার? পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থার ক্ষমতা প্রায় নিঃশেষিত। যাতায়াত-যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি জট-জটিল,। পণ্যমূল্য, দারিদ্র্য, দুর্নীতি, অপরাধ ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে। পরিবেশ-প্রকৃতি অবাধ তৎপরতায় লুণ্ঠিত ও বিধ্বস্ত। যে দেশের রাজনীতি সংঘাতপূর্ণ, অর্থনীতি বিপন্ন, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত ? সে দেশের রাজধানী আর বাঁচে কি করে? কমপিউটার যেমন হ্যাং হয়ে যায়... তার সিসটেম থেমে যায়, ? কিবোর্ড, মাউজ সহ কোনও ইনপুট ডিভাইস আর কাজ করে না... তেমন একটা অবস্থায় যেন পড়ে গেছি আমরা। তাহলে কি দিতে হবে রিস্টার্ট? স্থানান্তর করতে হবে রাজধানী, একেবারে গোড়া থেকে গড়তে হবে নতুন করে?
    তুগলকি চিন্তা?
    তা বলতে পারেন অনেকে। কিন্তু একালের ঐতিহাসিক-গবেষকরা একমত হয়েছেন ? দিল্লি’র তুরকি বংশীয় সুলতান মুহাম্মদ বিন তুগলক (রাজত্বকাল ১৩২৫-১৩৫১) মোটেই ক্ষ্যাপাটে ছিলেন না, তাঁর রাজধানী স্থানান্তর সহ সকল উন্নয়ন ও সংস্কার কার্যক্রম ছিল অত্যন্ত দূরদর্শী ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্তপ্রসূত উদ্যোগ। সে সবের বাস্তবায়ন যথাযথভাবে হতে পারে নি তাঁর অপদার্থ আমলা ও অজ্ঞ প্রজাদের অসহযোগিতায়। আসলে তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে।
    রাজধানী স্থানান্তর করেছেন আরও অনেকেই। সম্রাট হর্ষবর্দ্ধন (রাজত্বকাল ৬০৬-৬৪৬) থানেশ্বর থেকে রাজধানী সরিয়ে নেন কনৌজ-এ। সুলতান ইলতুতমিশ (রাজত্বকাল ১২১১-১২৩৬) লাহোর থেকে দিল্লিতে নিয়ে যান রাজধানী। আলাউদ্দিন খিলজি (রাজত্বকাল ১২৯৬-১৩১৬) কিছু দিনের জন্য রাজধানী করেছিলেন সিরি। সিকানদার লোদি (রাজত্বকাল ১৪৮৯-১৫১৭) দিল্লি থেকে রাজধানী নিয়ে গিয়েছিলেন আগরা। আকবর (রাজত্বকাল ১৫৫৬-১৬০৫) রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আগরা থেকে লাহোর, পরে ফতেপুর সিকরি-তে। শাহজাহান (রাজত্বকাল ১৬২৭-১৬৫৮) রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন শাহজাহানাবাদ, পরে আগরা-য়। আওরঙ্গজেব (রাজত্বকাল ১৬৫৮-১৭০৭) দিল্লি থেকে আগরা, পরে আওরঙ্গাবাদ-এ স্থানান্তর করেছিলেন রাজধানী। বাংলার নবাবেরা তাঁদের রাজধানী পাটনা, মুঙ্গের, রাজমহল, ঢাকা, মুরশিদাবাদ-এ স্থানান্তর করেছেন বিভিন্ন সময়। বৃটিশরাও তাদের রাজধানী স্থানান্তর করেছে কলকাতায়।
    কাজেই রাজধানী স্থানান্তরের কথা বলে মুহাম্মদ বিন তুগলককে ‘ক্ষ্যাপাটে’ বলা নিরর্থক। একালেও এ ধরনের স্থানান্তর চলছে পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে। এজন্যই ভারত গণরাজ্যকে দিললি ছাড়িয়ে নয়া দিললি বানিয়ে নিতে হয়েছে ১৯৩১ সাল থেকে। মালয়েশিয়া’র নতুন প্রশাসনিক রাজধানী এখন পুত্রজয়া। আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমার ইউনিয়ন ঐতিহ্যবাহী ইয়াঙ্গন ছেড়ে এখন উঠেছেন নতুন রাজধানী নেপিড’-তে। দক্ষিণ আফরিকা প্রজাতন্ত্রের রাজধানী তিনটি ? কেপ টাউন (আইনসভা), প্রিটোরিয়া (প্রশাসন), ব্লুমফনটেন (বিচার বিভাগ)। কিংডম অভ নেদারল্যান্ডস্‌-এর রাজধানী আসলে দু’টি ? আমস্টারডাম (দাপ্তরিক) ও দ্য হেগ (প্রশাসনিক)। তবে দ্য হেগ-এর নাম রাজধানী হিসেবে উল্লেখ করা হয় না সংবিধানগত কারণে। অথচ সেখানেই থাকেন রানী বিয়াট্রিঙ, সেখানেই বসে তাঁর দরবার। এছাড়া সংসদ, সরকার, সুপ্রিম কোর্ট, স্টেট কাউন্সিল, বিদেশী দূতাবাস, মন্ত্রণালয় প্রভৃতি সেখানেই অবস্থিত।
    প্রয়োজনের দাবি মানতে হবে আমাদেরও। ভাবতে হবে রাজধানী স্থানান্তর অথবা একাধিক রাজধানী স্থাপনের কথা। দীর্ঘ দিন ধরে জল্পনা চলছে রাজধানীর ভেতর থেকে বিজিবি সদর দপ্তর, কেন্দ্রীয় কারাগার, সচিবালয়, মন্ত্রীপাড়া, ঢাকা বিশ্বদ্যিালয় (প্রশাসন ও পরীক্ষা ব্যতিরেকে) প্রভৃতি স্থানান্তরের। এখন সময় এসেছে সে সব জল্পনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার এবং বাস্তবোচিত পদক্ষেপ নেয়ার। ঢাকার জন্য রিস্টার্ট আসলেই জরুরি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন